স্মৃতির পাতায় বন্ধু আমার

অধ্যাপক এম জহুরুল ইসলাম : নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর। গত শুক্রবারেই কি ভাবতে পেরেছিলাম আজ এই শিরোনামে আমার বন্ধু ও সহকর্মী এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে নিয়ে আমকে কিছু লিখতে হবে? আজ আমার বন্ধুর ঠাঁই হয়েছে স্মৃতির পাতায়, ইতিহাসের পাতায়- এটা ভাবতেই বুকের ভিতরে প্রচণ্ড এক বেদনা অনুভব করছি। তার স্বাভাবিক মৃত্যু হলে যতটুকু কষ্ট পেতাম তার চেয়ে এই কষ্ট হাজার গুণ বেশি। কারণ তাকে মানুষরূপী অমানুষরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এ ধরনের নির্মম পৈশাচিকতা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত।

সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। সেই ১৯৭২ সাল থেকে। তখন আমরা রাজশাহী কলেজে পড়ি। আমি একাদশ শ্রেনীতে আর তিনি দ্বিতীয় বর্ষ ইংরেজী সম্মান শ্রেণীতে। আমার আরো দুই সহপাঠী নজমুল আযম (এখন কানাডায় বসবাস করছেন) এবং এমদাদুল হক (ঢাকায় অবসর জীবনযাপন করছেন) সহ আমরা চারজন কলেজ হোষ্টেলের ‘এফ’ ব্লকের ১ নম্বর রুমে থাকতাম। বয়সে বড় হওয়ায় আমরা অন্য তিনজন তাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতাম এবং মুকুল ভাই বলে (তার ডাক নাম) ডাকতাম। আমাদের সে সময়টা ছিল খুব আনন্দের। প্রত্যেকেই আমরা নিয়মিত লেখাপড়া করতাম এবং প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বর্ণালী হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। চারজনেরই নামের শেষাংশ এক রকম হওয়ায় আমরা আমাদের রুমটার নাম দিয়েছিলাম ‘উল’ নিকেতন।

অসুস্থতার কারণে মুকুল ভাই দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিতে পারেননি। মনের দুঃখে রাজশাহী কলেজ ছেড়ে দিয়ে তিনি আমার সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে ১ম বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। তখন আমি তাকে ‘আপনি’ বাদ দিয়ে ‘তুমি’ বলে ডাকতে শুরু করি এবং বড় ভাই থেকে বন্ধুর সম্পর্কে নেমে আসি।

ছাত্রজীবনে আমরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষায় প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থান দুটি পালাক্রমে আমাদেরই ছিল। পড়াশোনার বাইরে সে খেলাধুলায় আগ্রহী ছিল। বিভিন্ন সময় সে ফুটবল এবং ভলিবল খেলত। আমি মাঠের খেলা খেলতাম না। তবে আবাসিক হলে টেবিল টেনিস খেলতাম। আমি হলে এবং সে তার পৈত্রিক বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত। যে কারণে আমরা আড্ডা দেয়ার সুযোগ তেমন পেতাম না। তবে বিভাগের নাটক, বিতর্ক ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে আমরা একসঙ্গে অংশগ্রহণ করতাম। তাই গান-বাজনাসহ সব রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার প্রচুর আগ্রহ ছিল।

প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এম এ পাস করার পরপরই আমরা শিক্ষক হিসেবে বিভাগে ঢুকতে পারিনি। বছর দুই আমরা সরকারি কলেজে চাকরি করেছি। পরে ১৯৮৩ সালে আমরা দুজন একসঙ্গেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। ছাত্রজীবন ও চাকরি জীবন মিলে সুদীর্ঘ ৪৪ বছর আমরা এক সঙ্গে কাটিয়েছি। এই দীর্ঘ সময়ের অনেক স্মৃতি এখন মনের কোঠায় ভিড় করছে। মনের যে অবস্থা তাতে সবকিছু প্রকাশ করার ভাষা আজ আমাকে সহযোগিতা করছে না। শুধু রাইজিংবিডি’র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মেহেদী হাসানের অনুরোধে এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।

অনেক বিষয়ের মধ্যে এটুক বলি, আমার বন্ধু প্রথম বর্ষের ছাত্রদের খুব যত্ন করে শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ নাটক পড়াতো। সিলেবাস থেকে এ নাটকটি কখনওই বাদ দিতে দিত না। শেক্সপিয়র পড়াতে পড়াতে কখন যে তার সঙ্গে শেক্সপিয়রের কাকতালীয় একটা মিল গড়ে উঠল তা আমরা কেউই জানতে পারিনি। জানা সম্ভবও ছিল না। জানলাম তার নির্মম মৃত্যুর পর। শেক্সপিয়র মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল। আর আমার বন্ধুর মৃত্যু হলো ঠিক তার ৪০০ বছর পর, ২৩ এপ্রিল। তবে এ মৃত্যু কারো কাম্য ছিল না। সে সমাজকে, জাতিকে আরো অনেক কিছু দিতে পারতো। মার্লোর ভাষায়- ‘Cut is the branch that might have grown full straight`. জর্জ অরওয়েলের ভাষায় আমি দেখতে পাই, ‘… the unspeakable wrongness (আমি বলতে চাই unspeakable brutality) of cutting a life short when it is in full tide`.

মানুষ হিসেবে সিদ্দিকী ছিলো অত্যান্ত সরল ও সহজ। তার মধ্যে কোনো শহুরে কৃত্রিমতা ছিল না। সে ছিল খাঁটি মনের মানুষ। গ্রামীণ প্রকৃতির প্রতি ছিল তার অগাধ ভালোবাসা। এমন একজন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করার মতো জঘন্য অপরাধের নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। আমি শুধু তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তার শোকাহত পরিবারের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। সেই সঙ্গে আশা করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দেবেন।

লেখক : অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।



মন্তব্য চালু নেই