‘স্যার, দুই টাকা বেশি দিছেন, নিয়ে যান!’

খালা, দুই কাপ চা। খালা, মানে দিলওয়ারা বেগম, চট করে চা বানিয়ে দিলেন। কক্সবাজারের লাবণী পয়েন্টে তাঁর চায়ের দোকান। স্থানীয় লোকজন সব সময় তাঁর দোকানে আসেন। পর্যটকেরাও সমুদ্রস্নানে যাওয়া-আসার পথে তাঁর দোকানে একটু গলা ভিজিয়ে নেন।

আমরা কজন সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর দোকানে চায়ের জন্য বসেছি। হঠাৎ শুনি দিলওয়ারা বলছেন, ‘স্যার, দুই টাকা বেশি দিছেন, নিয়ে যান!’ সাধারণত পকেট থেকে টাকা বের হলে আর ফিরে আসে না। কিন্তু এবার কক্সবাজার সমুদ্রতীরে বেড়াতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা হলো। ভদ্রলোক বললেন, ‘ঠিক আছে, রেখে দিন।’ কিন্তু দিলওয়ারার ঘোর আপত্তি। বলছেন, ‘না না, এটা আপনার টাকা। লাল চায়ের দাম পাঁচ টাকা, দুধ-চা ছয় টাকা। আপনারা তো দুই কাপ লাল চা নিয়েছেন।’

অগত্যা সেই ভদ্রলোক দুই টাকা ফেরত নিলেন।

কৌতূহল হলো। চায়ের দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দুই টাকা ফিরিয়ে দিলেন কেন, রেখে দিলেও তো পারতেন।’ দিলওয়ারা একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘দাম তো পাঁচ টাকা, বেশি দাম রাখার নিয়ম নেই।’ তাঁর নীতিগত অবস্থান আমাদের অবাক করে। দেশে যখন প্রায় সবাই নিয়ম ভেঙে চলেছে, সেখানে দিলওয়ারা ব্যতিক্রম।

অথচ খুব কঠিন অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হয় দিলওয়ারাকে। দুই ছেলে চায়ের দোকানে তাঁকে সাহায্য করে। স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। বললাম, ‘আবার বিয়ে করেছে নাকি? অনুমতি ছাড়া তো দুই বিয়ে হয় না। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন না কেন?’ তিনি বললেন, ‘না, থাক। আমি কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাই। কোনো ঝামেলায় যেতে চাই না।’ রাত ১২টা বা তারও বেশি সময় চায়ের দোকান চলে। পর্যটকেরা অনেক রাত পর্যন্ত সমুদ্রতটে থাকেন বলে তাঁর দোকানেরও কাটতি বেশি। আবার খুব ভোরে দোকান খুলতে হয়। কারণ, অনেক পর্যটক সাতসকালে সমুদ্রে যান। তখন তাঁর ছেলেরা দোকান চালায়। প্রতিদিন হাসিমুখে সংসারের বোঝা টেনে চলেছেন তিনি। যখন তাঁর ভরা সংসারের শুরু, তখনই তাঁকে একা ফেলে স্বামী চলে গেছেন। এর চেয়ে বড় অভিশাপ একজন নীতিনিষ্ঠ নারীর জীবনে আর কী হতে পারে।

সমুদ্রতীরে এখন কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়েছে বলেই দিলওয়ারার মতো আরও অনেক ছোট ব্যবসায়ীর কাজ চালানো সহজ হয়েছে। কয়েক বছর আগেও সেখানে এক অরাজক অবস্থা ছিল। কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। এখন পর্যটন পুলিশ পুরো এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের টহল চলে সব সময়। সাগরতীরে নেই ফেরিওয়ালাদের উৎপাত। দোকানগুলোও খুব সুন্দর করে সাজানো। সমুদ্রতীরে শুয়ে-বসে একটু আরাম করার জন্য সারি সারি ছাতা বিছানো আরাম-চেয়ার। খুবই সামান্য ভাড়ায় আপনি নিতে পারেন সেসব চেয়ার। আগে তো রীতিমতো দরাদরি করে, অনেক বেশি দামে সেসব চেয়ার নিতে বাধ্য করা হতো। এখন ওই সব হাঙ্গামার অবসান হয়েছে। অবশ্য ভাড়া কমিয়ে আনা হয়েছে আগেই। এবার দেখলাম পুরো সমুদ্রতীর ছিমছাম, সাজানো। ময়লা ফেলার বাস্কেট রাখা হয়েছে প্রতিটি ছাতার পাশে। বালুতীর কেউ আর নোংরা করেন না।

ভাটার সময় লাল আর জোয়ারের সময় সবুজ পতাকা উড়িয়ে সবাইকে সমুদ্রে নিরাপদে নামার সংকেত দেওয়ার ব্যবস্থা তো আগে থেকেই ছিল। এবার একটা নতুন ব্যবস্থা দেখলাম। আগে তো সমুদ্রে নামতে ভয় হতো। কোথায় খাড়ি, কে জানে। কখন ঢেউ ভাসিয়ে নেয়, ভয়ে থাকতাম। এখন দেখলাম অন্তত দুই-তিন শ গজ দূরত্বে দুটি সাদা পতাকা লাগিয়ে সমুদ্রে নামার নিরাপদ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার জোয়ারের সময় অতি উৎসাহী কেউ সমুদ্রের বেশি গভীরে চলে গেলে বাঁশি বাজিয়ে তাকে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে।

এককথায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এখন পর্যটকদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। যদি যাতায়াত ও যোগাযোগব্যবস্থা আরও উন্নত করা যায়, তাহলে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে আরও অনেক বেশি পর্যটক আসবেন। আমাদের আয় বাড়বে।

স্কুলে পড়ার সময় থেকে আমি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বারবার গিয়েছি। কিন্তু এবার মাত্র তিন দিনের ভ্রমণে কক্সবাজারে অনেক পরিবর্তন দেখলাম। অনেক মোটেল-হোটেল। এখন পর্যটন মৌসুম না হলেও পর্যটক আসছেন। এবার মে দিবসের সঙ্গে ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। তাই অনেকে সমুদ্রের টানে চলে এসেছেন সৈকতে। আমাদের হোটেল কক্ষ থেকে সমুদ্র দেখা যায়। এটা বাড়তি আকর্ষণ। পাশের কক্ষে এসেছে একটি ছোট পরিবার। তাঁরা হঠাৎ দেখলেন টেবিলের ড্রয়ারে বেশ কয়েক হাজার টাকা। আগের কোনো অতিথি হয়তো ভুলে রেখে গেছেন। এ কথা তাঁরা জানালেন কাউন্টারের কর্মকর্তাদের। অনুরোধ করলেন যেন যোগাযোগ করে ফেলে যাওয়া ওই টাকা প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এখন তো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যুগ। খুব সহজেই কাজটা হয়ে যাবে। কিন্তু কারও টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পর্যটকেরা যে তাঁদের মূল্যবান সময় ব্যয় করতেও রাজি, সেটা আবার নতুন করে দেখলাম। বাঙালি সব সময়ই উদার মনের। কিছু লোক অবশ্য এদিক-ওদিক করে। কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম হিসেবেই দেখতে হবে। আসলে বেশির ভাগ মানুষই সরল, সাধারণ।

কিন্তু কক্সবাজারের রামুতে কয়েক বছর আগে ২০১২ সালে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেটা আমরা ভুলে যেতে পারি না। আমরা গেলাম রামুতে। এখন সেখানে সম্প্রীতি। আগেও ছিল, এখনো। মাঝখানে যারা সংঘাতে মেতে উঠেছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় সীমা বিহার এলাকায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারের উদ্যোগে সেখানে আবার নতুন উপাসনালয় ও ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে সীমা বিহারের ‘পণ্ডিত সত্যপ্রিয় পাঠাগার’-এ বই ও কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে। সেখানে দেখলাম কয়েকজন কিশোর পড়ছে। সীমা বিহারের প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষুর সঙ্গে আগে থেকেই আমাদের পরিচয় ছিল। তিনি প্রথম আলোয় লিখতেন। রামুর দুঃখজনক হামলার ঘটনার পর তিনি প্রথম আলোয় বেশ কিছু নিবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। এত সুন্দরভাবে ও বিনয়ের সঙ্গে কথা বলেন। এ ধরনের মানুষের ওপর কেউ আক্রমণ করতে পারে, তা ভাবা যায় না। কিন্তু সেদিন সে রকম হয়েছিল। পরে অবশ্য শান্তিপ্রিয় সব মানুষ এক হয়ে রুখে দাঁড়ায়। এলাকায় শান্তি ফিরে আসে।

এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা হলো। সবাই সম্প্রীতির সঙ্গে থাকতে চায়। সেটাই বড় কথা। বাংলাদেশে আমরা সবাই শান্তিতে থাকতে চাই।

কেউ যদি কখনো রামুতে বেড়াতে যান, তাহলে অবশ্যই রাংকূট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার ঘুরে আসবেন। সেখানে দেখা হলো অর্পণ বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি স্নাতকোত্তর পর্বে পড়ছেন। স্থানীয় একটি পত্রিকার সাংবাদিক। তাঁর সঙ্গে আমরা গেলাম সেই বৌদ্ধ বিহারে। শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। পুরো চত্বরজুড়ে গাছপালা। ছোট পাহাড়ের ওপর সুন্দর উপাসনালয়। বলা হয়, সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পর শান্তি ও অহিংসার বাণী প্রচারে মিয়ানমার যাচ্ছিলেন। পথে ওই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি প্রায় সোয়া দুই হাজার বছর আগে এই বনাশ্রম নির্মাণ করেন। সেদিক থেকে এটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক ঐতিহাসিক উপাসনালয়। শিশুরা আঙিনায় ক্রিকেট খেলছে। পাখিরা গাছের ডালে ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে। ভীষণ গরমের মধ্যে ঠান্ডা বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

ফিরে আসি কক্সবাজার সৈকতে লাবণী পয়েন্টের চায়ের দোকানি দিলওয়ারা বেগমের কথায়। তাঁর কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। কষ্ট করে চলব কিন্তু নীতিবিচ্যুত হব না। দিলওয়ারা বেগমের আর্থিক দারিদ্র্য আছে কিন্তু মনের দারিদ্র্য নেই। আমরা মধ্য আয়ের অর্থনীতির সিঁড়িতে পা রেখেছি। অর্থনৈতিকভাবে আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি। কিন্তু মন-মানসিকতায় আমরা কি মধ্যম মানে পৌঁছাতে পারব?

আব্দুল কাইয়ুম

সাংবাদিক



মন্তব্য চালু নেই