হজকোটা বণ্টন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ

হজকোটায় অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রাক নিব্ন্ধনের নম্বর অনুক্রম ভঙ্গ করে হাজি পাঠানো, ঘুষ খেয়ে হজকোটা বরাদ্দ দেয়াসহ নানা অভিযোগ এনে এরইমধ্যে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে একটি উকিল নোটিস পাঠিয়েছে একটি হজ এজেন্সি।

ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) সদস্যদের সূত্রে জানা গেছে, সৌদি সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে বাংলাদেশ থেকে এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এক লাখ এক হাজার ৭৫৮ জন হজে যেতে পারবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দশ হাজার এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ যাত্রী যেতে পারবেন ৯১ হাজার ৭৫৮ জন। কিন্তু এরইমধ্যে প্রাক নিবন্ধন করেছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৯৫১ জন হজ গমনেচ্ছু যাত্রী। প্রায় ৪৮ হাজার হজ গমনেচ্ছু কোটার অতিরিক্ত প্রাক নিবন্ধিত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং একাধিক হজ এজেন্সি অভিযোগ করেছে, এ বছর বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবে ১০ হাজার হজযাত্রী হজে যাওয়ার অনুমোদন পায়। কিন্তু সরকারি কোটার হজযাত্রী পাওয়া যায় ৫ হাজার ২শ’। বাকি চার হাজার আট শ’ সরকারি কোটা বেসরকারি হজ এজেন্সির মধ্যে বণ্টনের সিদ্ধান্ত হয়।

হাবের বার্ষিক সাধারণ সভায় ধর্মমন্ত্রীও এই কথা বলেছিলেন। সৌদি সরকারের কাছ থেকে এখনো অনুমতি না পাওয়া গেলেও ইতোমধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি এজেন্সির মধ্যে সরকারি কোটা এজেন্সিগুলোর কাছে মোটা অংকে বিক্রি-বণ্টন শুরু করে দেয়। অভিযোগ উঠছে, সিন্ডিকেট এই কোটা থেকে গড়ে হজযাত্রী প্রতি ২০ হাজার ৩০ হাজার টাকা করে নেয়া হচ্ছে। চার হাজার আট’শ কোটার বিপরীতে সিন্ডিকেটটি ১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

একাধিক হজ এজেন্সি মালিক অভিযোগ করে বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২২ জুন পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিবন্ধিত হয়েছে ৪ হাজার ৭২৪ জন। কিন্তু এখানে মন্ত্রণালয় নিবন্ধন দেখিয়েছে ৫ হাজার দুই’শ জনকে। এখানে ৪৭৬ জন হয যাত্রী কিভাবে অন্তর্ভুক্ত হলো, সে ব্যাপারে কেউ কিছুই বলতে পারেনি। এখানেও ৪৭৬ জনের কোটা নিয়ে অবৈধ লেনদেন হয়েছে বলে তারা মনে করেন।

হাবের মহাসচিব শেখ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সৌদি সরকার ৪ হাজার ৮০০ কোটা সরকারি থেকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হস্তান্তরের জন্য অনুমোদনই দেয়নি, সেখানে কিভাবে কোটা ভাগাভাগি বা বন্টন হয়? এটা সঠিক নয়। আর হাবের বিরুদ্ধেও ওঠা অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।

অপরদিকে সৌদি সরকার থেকে এবছর বেসরকারি হজযাত্রীর অনুমোদন দেয়া হয় ৯১ হাজার ৭৫৮ জনকে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ২২ জুনের তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় নিবন্ধত হয়েছে ৮৬ হাজার ২৯ জন। খালি ছিল ৫ হাজার ৭২৯টি। পরবর্তীতে বিভিন্ন আদেশের মাধ্যমে বাকী কোটাগুলো পূর্ণ করা হয়। এর মধ্যে নিয়ম ভঙ্গ করে ধর্ম মন্ত্রণালয় ১৬ জুলাই একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৫টি হজ এজেন্সির নামে ৭৮১ জনকে হজ কোটা বরাদ্ধ দেয়া হয়।

পরিচালক হজ অফিস আশকোনা বরাবর পাঠানো ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. শহীদুল্লাহ তালুকদারের স্বাক্ষরে ১৭ জুলাই তারিখের ওই প্রজ্ঞাপনে যেসব এজেন্সির অনুকূলে কোটাগুলো দেয়া হয়েছে সেসব এজেন্সির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ময়মনসিংহ ট্রাভেল এজেন্সি (১০১ জন), মাদার ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনাল (১০০ জন), আশা ইন্টরন্যাশনাল লিমিটেড (১০২ জন), আহনাফ ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস (১২৩ জন), আল-আমিন ইন্টারন্যাশনাল (৭৪ জন), হিমেল এয়ার ট্রাভেলস (৯৮জন), মদিনা এয়ার ইন্টরন্যাশনাল এভিয়েশন (৭১ জন) এবং দি সিটি ট্রাভেলস (৪৬জন)।

এদিকে হজ বিষয়ক ওয়েবসাইটে হজ সম্পর্কিত সব প্রজ্ঞাপন দেয়া হলেও এই প্রজ্ঞাপনটি সেখানে দেয়া হয়নি। গোপনে প্রজ্ঞাপন জারি করে নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করে হজযাত্রীদের তালিকা সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ‘কোটা বরাদ্দে যে অনিয়ম হয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সর্বশেষে গত ২৩ জুলাই ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর সৌদি আরব জেদ্দা বাংলাদেশ হজ অফিসের কাউন্সিলর (হজ) মুহাম্মদ মাকসুদুর রহমান স্বাক্ষরিত ‘অতীব জরুরি লেখা’ একটি চিঠিতে। ওই চিঠির বিষয় ছিল- চূড়ান্ত তালিকার প্রেরিত ৪৮৩টি হজ এজেন্সির হজযাত্রীর সংখ্যা পরির্বতন/সংশোধন না করার প্রসঙ্গে। এই চিঠিই প্রমাণ করে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে তালিকা পাঠিয়েছে।

ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘হজ ২০১৬ মৌসুমে বাংলাদেশ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আগতব্য ৪৮৩টি এজেন্সির অনুকূলে ২৩/০৪/২০১৬ তারিখে ৮৭৭০৯ জন, ০৩/০৫/২০১৬ তারিখে ৯০৩৫২ জন, ১৭/০৭/২০১৬ তারিখে ৯০৪৯৩ জন এবং সর্বশেষ ১৯/০৭/২০১৬ তারিখে ৯১৭৫৮ জন হজযাত্রীর চূড়ান্ত তালিকা প্রেরণ করা হয়। প্রেরিত তালিকা অনুযায়ী ইতোমধ্যে হজযাত্রী সংখ্যা ৩ বার সংশোধন করা হয়েছে। অনেক এজেন্সি পূর্বে এন্টিকৃত হজযাত্রী সংখ্যা অনুযায়ী মোনাজ্জেম কার্য তৈরি করে বাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। হজযাত্রী সংখ্যা বার বার পরিবর্তনের কারণে ২১/০৭/২০১৬ তারিখে মোয়াচ্ছাছা হতে জানানো হয়েছে যে, কোনো এজেন্সির বিপরীতে হজযাত্রী সংখ্যা পরিবর্তন গ্রহণ করা হবে না। এমতাবস্থায় ১৯/০৭/২০১৬ তারিখে প্রেরিত চূড়ান্ত তালিকা বহাল রেখে কোন এজেন্সির অনুকূলে হজযাত্রী সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধি না করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’

এই চিঠির অনুলিপি রিয়াদ বাংয়লাদেশের রাষ্ট্রদূত, জেদ্দা কনসাল জেনারেল, ধর্মমমন্ত্রীর একান্ত সচিব এবং আশকোনা হজ অফিসের পরিচালককে এই অনুলিপি দেয়া হয়।

একাধিক হজ এজেন্সির মালিক অভিযোগ করে বলেছেন, এই চিঠির মাধ্যমেই প্রমাণ হয় হজকেন্দ্রিক শক্তিশালী সিন্ডিকেটটি বারবার কিভাবে অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে কোটা পূরণে করেছে। নিয়ম ভঙ্গ করে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময় প্রতিটি কোটা বেচা-কেনা হয়েছে।

সিরিয়াল বঞ্চিত হজ এজেন্সি মালিকরা অভিযোগ করেছেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়, হাব এবং দুইজন সংসদ সদস্য এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। এই চক্রটি নিয়ম ভঙ্গ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ কারণে সাধারণ হজ এজেন্সি নিয়মের মধ্যে থাকলেও তারা সিন্ডিকেটের কারণে বঞ্চিত হচ্ছে।

অনিয়ম এবং সিরিয়াল ভঙ্গের অভিযোগ এনে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিবকে আইনী নোটিশ প্রদানকারী আল-জিয়ারাত ইন্টারন্যাশনালের মালিক আবুল কালাম বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমি সিরিয়ালে থাকলেও আমাদেরকে বাদ দিয়ে সিরিয়ালের বাইরের থাকা এজেন্সীদের নামে কোটা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এখানে পরবর্তীতে যে কোটাগুলো বিভিন্ন এজেন্সির নামে দেয়া হয় সবগুলোই অবৈধ আর্থিক লেনদেন মাধ্যমে দেয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি আইনজীবীর মাধ্যমে উকিল নোটিশ সচিব বরাবর পাঠিয়েছি, আগামী ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে এই আইনী নোটিশের জবাব না দিলে আদালতে আশ্রয় নেবো।’

হজ এজেন্সি মালিকেরা বলেছেন, নিয়ম অনুযায়ী, হজনীতি, হজ প্যাকেজ, সরকারি ঘোষণায় প্রাক রেজিস্ট্রেশনের সময় এবং পরবর্তী সময়ও বলা হয়েছে অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সিরিয়াল পড়বে। সেই সিরিয়াল অনুযায়ীই হজযাত্রীরা কোটার মধ্যে হজের জন্য অগ্রাধিকার পাবেন। যারা এ বছর কোটায় সিরিয়ালে আসবেন না, তারা পরবর্তী বছর অগ্রাধিকার পাবেন। এছাড়া একান্তই মাহরিম, নিকটাত্মীয়জনিত ব্যাপার ছাড়া অন্য কোনো কারণে সিরিয়াল ভঙ্গ করার কোনো সুযোগই নেই। কিন্তু এই নিয়ম ভঙ্গ করে এসব কোটা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে হাব সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক এবং হজ এজেন্সি প্যান ব্রাইট ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আমিন মিন্টু বলেন, ‘অন্যায়ভাবে সিরিয়াল ভঙ্গ করা হয়েছে। তারা কোটা বণ্টনের বিনিময়ে বিপুল টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিচ্ছে।’

তিনি এ দুর্নীতির নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে এ কোটা বাতিল করে সব এজেন্সির মাঝে সমভাবে কোটাগুলো বণ্টনের দাবী জানান।

তিনি বলেন, ‘হজ নিয়ে বর্তমান সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হোক সেটা আমরা চাই না। আমরা দুর্নীতিমুক্ত হজ চাই।’

হাব সমন্বয় পরিষদের সদস্য সচিব ও হজ এজেন্সির ব্রাইট ট্রাভেলস এর স্বত্বাধিকারী রেজাউল করিম উজ্জ্বল বলেন, ‘হাবের কয়েকজন নেতা এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।’

তবে হাবের মহাসচিব শেখ আব্দুল্লাহ এসব অনিয়মের সঙ্গে হাব জড়িত নয় দাবি করে বলেছেন, ‘হাব এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত নয়। কোটা ভাগাভাগির বিনিময়ে কোনো এজেন্সির কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়েছে, এমন খবর আমার কাছে নেই।’

এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত ধর্মসচিব মো. আব্দুল জলিলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে এক ব্যক্তি ফোন রিসিভ করে, ‘স্যার মিটিং আছেন’ বলেই কেটে দেন।

উল্লেখ্য, আগামী ৩ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর আশকোনা হজক্যাম্পে হজ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন ৪ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্স যৌথভাবে বাংলাদেশের হজযাত্রীদের পরিবহন শুরু করবে। হজ ফ্লাইট চলবে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আর ফিরতি ফ্লাইট ১৭ সেপ্টেম্বও থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে ১৬ অক্টোবর।বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই