হতাশায় বিএনপি : শেষ চালেও আ.লীগের বাজিমাত

ঘটনাবহুল সময়। প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটছিলো। রাজনীতির গতিপথ কখনো কখনো এতো দ্রুত বদলায় যে, ইতিহাসেরও তা ধরতে বেগ পেতে হয়। ২০০৬ সাল। ওই বছরের শেষ প্রান্তের প্রতিটা দিনই ছিল ইতিহাসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান অপেক্ষা করছিলেন কখন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেবেন। পরে তিনি বলেছিলেনও, প্রস্তুত ছিলাম। কপালে ছিল না। তাই হতে পারিনি। তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ পুরো বিরোধী শক্তি কেএম হাসানকে মানতে রাজি নন। তাদের প্রধান যুক্তি- কেএম হাসান একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাছাড়া, তাকে প্রধান উপদেষ্টা করার জন্যই বিএনপি বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়েছিলো।

অন্যদিকে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার কেএম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করতেই বদ্ধপরিকর। এই একটি ইস্যুতে রাজপথ ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছিলো। হরতাল-অবরোধে অচল হয়ে পড়ে গোটা দেশ। সংকট সমাধানে ২০০৬ সালের অক্টোবরে সংলাপে বসেন তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। সংসদ ভবনে দুই দলের সম্পাদক পর্যায়ের আশাজাগানিয়া সংলাপ চলে একাধিক দিন। গোটা দেশের দৃষ্টি তখন সংসদ ভবনে। কি হয় দুই দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তির সংলাপে। শেষ পর্যন্ত ওই সংলাপ ফটোসেশন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। সংলাপ ব্যর্থ হয়। রক্তাক্ত পরিস্থিতিতে ওই বছর ২৮শে অক্টোবর বিচারপতি কেএম হাসান একটি বিবৃতি দেন।

তাতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ভেঙে যাওয়ায় আমাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।’

পরে অবশ্য জানা যায়, রাজপথে আন্দোলন ছাড়াও ঢাকায় নিযুক্ত কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিক এ ব্যাপারে কেএম হাসানকে প্রভাবিত করেছিলেন। একপর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তার নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত থাকে। আওয়ামী লীগ জোট সরে দাঁড়ালে ২২শে জানুয়ারির নির্বাচন ভেস্তে যায়। একপর্যায়ে সেনা হস্তক্ষেপে পদত্যাগ করেন প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর সময়ও ছিলো ঘটনাবহুল। শুরুতে ওই সরকারের প্রতি আওয়ামী লীগ সমর্থন প্রকাশ করলেও এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের ওপরও ক্র্যাকডাউন নেমে আসে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও। চেষ্টা চলে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ কার্যকরের।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য কোনো চেষ্টাই হালে পানি পায়নি। পর্দার অন্তরালে চলে সমঝোতার প্রচেষ্টা। কাদের সঙ্গে সমঝোতা হয় তা অবশ্য স্পষ্ট। ২০০৮ সালের শেষ প্রান্তে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় পায় আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে দুটি ইস্যু খুব নিপুণভাবে কাজে লাগায় দলটি। ১. যুদ্ধাপরাধের বিচার ২. ডিজিটাল বাংলাদেশ। এই দুটি ইস্যুই তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়। পরে ক্ষমতায় এসে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগ। রাজনীতি যদি দাবার খেলা হয় তবে সবসময় প্রতিপক্ষ থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলেন ক্ষমতাসীনরা। একের পর এক ইস্যু তৈরি করেন তারা। বিরোধীরা ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। রাজনীতিতে চলতে থাকে নানা ধরনের কার্ডের খেলা। বাতিল করে দেয়া হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। বার বার সামনে আসে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যু। এই একটি ব্যাপারে সবসময়ই দৃঢ় অবস্থানে থাকে আওয়ামী লীগ। দেশি বা আন্তর্জাতিক কোনো চাপকেই আমলে নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের মুখোমুখি করা হয় বিচারের। প্রফেসর ইউনূস ইস্যুতেও অনড় অবস্থান নেয় সরকার। সবাইকেই একটি বার্তা দেয়া হয়, কোনো চাপের কাছেই সরকারের গতিপথে পরিবর্তন আসবে না। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধেও দৃঢ় অবস্থান নেয় সরকার। যা তাদের ভারতের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেতে সহযোগিতা জোগায়।

৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ঘটে নানা নাটকীয়তা। বিএনপি নেত্রীকে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমন্ত্রণ জানানো হয় নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিতে। খালেদা জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেন। বিরোধীদের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন মোকাবিলা করা হয় কঠোর হস্তে। নানা গুজবের মধ্যেও সরকার ছিল ধীর-স্থির। নির্বাচন হয়ে গেলে আবার সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। একটা সময় আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রচণ্ড চাপ ছিল। একমাত্র ভারত ছাড়া সবাই চাপ দিচ্ছিলো একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত কৌশলী ভূমিকায় সে চাপ মোকাবিলা করে। এক পর্যায়ে সবাই সরকারকে মেনে নেয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ অবশ্য সরকারের পক্ষে ছিলো। সহায়ক ছিলো বিরোধী শক্তির ব্যর্থতাও। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নমূলক কার্যক্রম জনগণের সামনে তুলে ধরতে শতভাগ সাফল্যের পরিচয় দেয় সরকার।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজনীতি এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে বিরোধীরা নিজেদের কোনো দাবি শক্তমতো উত্থাপনও করতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন গঠন ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। নতুন কমিশন গঠনের পুরো প্রক্রিয়ায় বিএনপি অংশগ্রহণও করেছে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপের পাশাপাশি সার্চ কমিটির কাছে নামের তালিকাও দিয়েছে দলটি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠনের পর যথারীতি বিএনপির মধ্যে নেমে এসেছে গভীর হতাশা। বিশেষ করে নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদার অতীত বর্ণনা করে তার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। ঢাকার বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির সর্বশেষ চালেও বাজিমাত করেছে আওয়ামী লীগ।

তবে এই সফলতা নিয়েও নির্ভার নয় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনরা এখন হিসাব কষছেন আগামী নির্বাচন নিয়ে। কয়েকমাস ধরেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সংগঠন গোছানোর কাজ এগিয়ে চলছে। দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি। নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজও চলছে। ভোটের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, আগামী নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে। ওই নির্বাচনেও বাজিমাতের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। পরিস্থিতি যাই হোক। খবর মানবজমিনের।



মন্তব্য চালু নেই