হাওরে তলিয়ে গেছে ৫ হাজার কোটি টাকার ফসল

বর্ষা মৌসুম শুরুর অনেক আগেই তলিয়ে গেছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভাটি এলাকার বিভিন্ন হাওর। এতে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া— এই ছয়টি জেলায় তলিয়ে গেছে ৩ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমির ১৫ লাখ টনেরও বেশি ধান। এই বিপুল পরিমাণ ধানের বাজারমূল্য পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

এই ছয়টি জেলার হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এসব জেলার কৃষকরা। এদিকে, ধান পচে পানি দূষিত হয়ে মারা যাচ্ছে মাছ। জেলাগুলোর হাঁস-মুরগির খামারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে, হাওর এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় গো-খাদ্যের অভাবে কৃষকরা নামমাত্র দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন গবাদি পশু।

সুনামগঞ্জ: অকাল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলায় একের পর এক ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে দেড় লাখ হেক্টর জমির কাঁচা বোরো ধান। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জেলার তিন লাখ ৩৩ হাজার কৃষি পরিবার। আর আর্থিক মূল্যমানে তলিয়ে যাওয়া ফসলের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।

এছাড়া, গত কয়েকদিনে ২৫ মেট্রিক টন দেশীয় প্রজাতির মাছ মারা গেছে বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য অফিস। এরও বাজার মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা।

হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক অব. অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, ‘৯০ ভাগ কৃষকের ঘরে খাবার নেই। বেশিরভাগ কৃষক সরকারি, বেসরকারি ও মহাজনী ঋণের জালে আবদ্ধ। বেঁচে থাকার তাগিদে ও গো-খাদ্যের অভাবে প্রায় সব কৃষক গৃহপালিত গবাদিপশু কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।’

জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তা ডা. বেলায়েত হোসেন জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জ জেলায় মোট ২৫ লাখ ১৩ হাজার ৮৩৩টি হাঁস ও ২ হাজার ৭০৭টি হাঁসের খামার রয়েছে। বন্যা আর ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এসব খামারও। তাতে আরও ১০৫ কোটির টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে।

কিশোরগঞ্জ: এ জেলায় এখন পর্যন্ত ৪৫ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। তবে চাষীদের দেওয়া বক্তব্য ও অন্যান্য সূত্রের খবর অনুযায়ী, পানিতে তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর পর্যন্ত হতে পারে। সরকারি হিসাবে এই জেলায় ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা। বেসরকারি হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় আটশ কোটি টাকা।

জেলার ইটনা উপজেলার বড়িবাড়ী ইউনিয়নের চেয়াম্যান আ. রউফ ভুইয়া বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের প্রায় শতভাগ জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। সবগুলো বাঁধ ভেঙে গেছে। কৃষকরা একটি ধানও ঘরে তুলতে পারবেন না। অভাবের তাড়নায় কেউ কেউ গরু, ছাগল বিক্রি করে দিচ্ছেন।’

মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী ইউনিয়নের চেয়াম্যান নুরুল হক বাচ্চু বলেন, ‘বুধবার (১৯ এপ্রিল) গোপদিঘীর সর্বশেষ সিংগা বাঁধটিও ভেঙে গেছে। যে সামান্য জমি প্লাবিত হওয়া বাকি ছিল, তাও শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা গেল না।’ কৃষকদের বাঁচাতে সব ঋণ মওকুফের পাশাপাশি জলাশয়ের লিজ বাতিল করার দাবি জানান এই ইউপি চেয়ারম্যান।

এদিকে, বিভিন্ন জেলায় মাছের ক্ষতি হলেও কিশোরগঞ্জে মাছের ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম।

মৌলভীবাজার: জেলার হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, সোনাদিঘি, কাওয়াদিঘির হাওর ও কইরকোনা বিলসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০ হাজার ২শ ৭৬ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, এর ফলে একশ ২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. শাহজাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তার চেষ্টা চলছে। ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে আমন মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে চাষাবাদের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।’

শুধু ধানই নয়, কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় হাকালুকি হাওরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছও মরে যাচ্ছে। তবে কী পরিমাণ মাছ মারা গেছে, এর কোনও পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি।

বড়লেখা উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবু ইউছুফ বলেন, ‘হাওরে মাছের অবস্থা খুবই খারাপ। বাইন মাছ সাধারণত কাদায় থাকে। কিন্তু বিষক্রিয়ায় অন্যান্য মাছের পাশাপাশি এ মাছও মরে ভেসে উঠছে।’

নেত্রকোনা: ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার ৪৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমির বোর ধান সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। এতে নষ্ট হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৩২ মেট্রিক টন ধান। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ লাখ ১০ হাজার ৪৭০টি কৃষক পরিবার। ক্ষতির নগদ আর্থিক মূল্য প্রায় ৭শ ৩৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

এছাড়া, জেলার বিভিন্ন হাওরে মরতে শুরু করেছে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী। প্রতিবছর এই জেলার হাওর থেকে ৭শ কোটিরও বেশি টাকার মাছ ধরা হয়। জেলার মৎস কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন আহম্মদ জানিয়েছেন, এ বছরে প্রত্যাশিত পরিমাণে মাছ বিক্রি সম্ভব হবে না।

এদিকে, ধান-মাছ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি এলাকায় গো-খ্যাদ্যের অভাবে কৃষকরা গবাদি পশু বিক্রি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ কৃষকদের সংকটের এই সময়ে গবাদি পশুর দামও নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। শফিকুল ইসলাম নামে একজন কৃষক বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চালসহ সব জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ বাজারে আমাদের গরু-ছাগল বিক্রি করতে গেলে দাম পাচ্ছি না। এখন জানি না আমরা কী করব।’

হবিগঞ্জ: বন্যা, বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে হবিগঞ্জের ৩৫ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এতে করে কেবল ফসলের জন্যই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪শ কোটি টাকারও বেশি।

হবিগঞ্জ কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে জেলার ৮টি উপজেলায় প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। অকাল বন্যা এবং গত দুই দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে জেলার গুঙ্গিয়াজুরি হাওর, গণকির হাওর, ভরগাও হাওর, কালুয়ার বিল, খাগাউড়া হাওরসহ জেলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন জেলার কৃষকরা। যেটুকু জমি এখনও পানিতে তলিয়ে গেছে, সেগুলোর ধান আধাপাকা অবস্থাতেই কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা।

বানিয়াচং উপজেলার সারামপুর গ্রামের কৃষক মনর উদ্দিন বলেন, ‘অনেক আশা নিয়ে ঋণ করে জমি চাষ করেছিলাম। কিন্তু অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে সব হারিয়ে গেছে। এখন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে পথে বসা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।’

হবিগঞ্জ জেলা কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. ফজলুর রহমান জানিয়েছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষকদের যতটাসম্ভব সহয়তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: এই জেলায় মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাসিরনগর উপজেলার কৃষি জমিগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ অন্তত দুইশ হেক্টর বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আনিছুজ্জামান। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় আড়াই কোটি টাকা। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে তাদের সহায়তার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই