হাজার টাকার গরু, ইনজেকশনে লাখ!

আর কদিন পরই মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে এদিন লাখো পশু জবাই দেবেন তার অনুগতরা। ঈদকে সামনে রেখে এরই মধ্যে জমতে শুরু করেছে কোরবানি পশুর হাটগুলো। কোরবানির বাজারে পশুর এমন চাহিদার সুযোগে উঁৎ পেতে রয়েছে অতি মুনাফা লোভী অসাধু ব্যবসায়ী ও খামারিরা। তারা ক্রেতাদের ঠকাতে বিভিন্ন উপায় বেছে নিয়েছে। কোরবানির বাজারের বিভিন্ন হাল চিত্র নিয়ে  বিশেষ আয়োজন ‘কোরবানির হালচাল’।

প্রতিবছর কোরবানিকে কেন্দ্র করে ভারত থেকে লাখ লাখ গরু আসতো বাংলাদেশে। কিন্তু এ বছর তা অনেকটাই বন্ধ রয়েছে। এতে কোরবানি পশু সঙ্কটের আশঙ্কা করছেন পশু ব্যবসায়ীরা। তবে কোরবানির পশুর এ ঘাটটি মেটাতে পদক্ষেপও নিয়েছেন তারা। আর তা হচ্ছে অবৈধ ও অস্বাস্থ্যকর উপায়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে পশু মোটাতাজা।

জানা গেছে, স্বাভাবিক খাদ্য খেয়ে যে গরুটি বেড়ে উঠে সেটি একটু কম মোটাতাজা হয়ে থাকে। ফলে তার দাম কিছুটা কম। অথচ পশু বিশেষজ্ঞদের মতে এ গরুই পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসম্মত। কিন্তু অসাধু গরু খামারি ও ব্যবসায়ীরা মাত্র এক থেকে দেড় হাজার টাকার একটি ইনজেকশনের মাধ্যমে গরুকে মোটাতাজা করে লাখ টাকায় রূপান্তর করে। আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা তৎপর।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্টেরয়েড, কোর্টিসল, ডেক্রামিথাসন, হাইড্রোকর্টিসন, বিটামিথাসন ও প্রেডনিসলনের মতো মারাত্মক হরমন ব্যবহার করে কোরবানি পশু মোটাতাজা করা হচ্ছে। এ ওষুধগুলো এতোই মারাত্মক যে আগুনেও এর ক্ষতিকর প্রভাব নষ্ট হয় না। ফলে এসব গরুর মাংস রান্নার পরও ওষুধের ক্ষতিকারক দিক নষ্ট হয় না।

চিকিৎসকরা জানান, স্টেরয়েড ব্যবহারে মানুষের কিডনি, লিভার, অন্ধত্ব, পুরুষত্ব, মাতৃত্বহীনতা ও ক্যানসারসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে দুরারোগ্য রোগ দেখা দিতে পারে। একই সঙ্গে এসব ওষুধের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে আসে। কমে আসে চোখের জ্যোতিও। এসব পশুর মাংশ খেলে মানবদেহে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হতে পারে।

গরু ব্যবসায়ী ও পশু চিকিৎসকরা জানান, খামারি ও ব্যবসায়ীরা গরু মোটাতাজা করার জন্য কোরবানির ঈদকেই উপযুক্ত সময় হিসেবে বেচে নেয়। ঈদের মাত্র কয়েক দিন আগেই পশু খামারগুলোতে ইনজেকশনের মাধ্যমে গরুতে এ ধরনের ওষুধ প্রবেশ করায়। তারা একটি পশুকে তার সহ্যের ৫ থেকে ১০ গুণ বেশি ওষুধ দেয়। এতে খুব দ্রুত পশুর চামড়ার ভেতরে বাড়তি চর্বি ও অতিরিক্ত পানি জমে। ফলে পশুকে দেখতে খুব মোটাতাজা দেখায়। বাহ্যিকভাবে পশুর সৌন্দর্যও বাড়িয়ে তুলে। এতে পশু মোটা হলেও মাংস ওজনে কম ও স্বাদহীন হয়ে পড়ে। জবাইয়ের পর মাংসে জমাট রক্ত, কালচে দাগ দেখা যায়। মাংসে অতিরিক্ত পানিও থাকে।

কোরবানির ঈদকে টার্গেট করে অতিরিক্ত লাভের আশায় কিছু ব্যাপারী ও পশু ব্যবসায়ী বাড়ন্ত, অল্পবয়সী, চিকন ও কঙ্কাল পশু কিনে হরমন, ইনজেকশন ও ট্যাবলেট খাইয়ে অল্প সময়ের মধ্যে মোটাতাজা করে পশুহাটে বিক্রি করেন। হাজার টাকা দামের একটি ইনজেকশন ও ট্যাবলেট ব্যয় করে লাখ টাকার মুনাফা অর্জন করতে বেপরোয়া এই ব্যবসায়ীরা। তারা ঈদের মাত্র ২০ থেকে ২৫ দিন আগই একাধিক ট্যাবলেট খাইয়ে দেয় গরুকে এবং ইনজেকশনও দেয়া শুরু করে। এতে পশুর হরমন বেড়ে গিয়ে খাবার ক্ষমতা বেড়ে যায়। ফলে অতিদ্রুত মোটা হয়ে উঠে পশু। কিন্তু এসব পশু বেশিদিন বাঁচে না।

জানা গেছে, ডেক্সমেথাসন বা ওরাডেক্সন স্টেরয়েড-জাতীয় ট্যাবলেট দিয়ে ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে গরু মোটাতাজা করা হয়। এসব ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে চোরাই পথে তা বাংলাদেশেও আসে। এর দাম তুলনামূলক কম। প্রতিদিন পশুকে পাঁচ থেকে সাতটি করে ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। এতে মাত্র অল্প কয়েক দিনেই অতিমাত্রায় মোটা হয়ে ওঠে পশু। দেখতে সুন্দর ও মোটাতাজা দেখায় গ্রাহকরা পশুরহাট থেকে অধিক দামে পশু কিনে নিয়মিত প্রতারিতও হচ্ছেন। পাশাপাশি এর মাংশ খেয়ে কঠিন ঝুঁকিতে পড়ছেন তারা।

তবে এসব বিষয়ে একটি আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। নেই কোরবানি পশুর হাটগুলোতে তেমন কোনো প্রচারণাও। প্রচারণা না থাকায় আসন্ন কোরবানিতেও গ্রাহকরা প্রতারিত হতে পারেন বলেও আশঙ্কা করছেন ভুক্তভোগীরা। এ অবস্থায় পশু বিশেষজ্ঞরা কোরবানির জন্য পশু বাছাই করতে ছোট ও কম মেদযুক্ত পশু কেনার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি যেসব পশু অতিরিক্ত মোটা, নড়াচড়া করে না, মুখ দিয়ে অস্বাভাবিক নালা ঝরে, ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না, সার্বক্ষণিক শরীর ভেজা কাপড় দিয়ে রাখতে হয় এমন পশু কেনা থেকে বিরত থাকতেও পরামর্শ দিয়েছেন।

যেভাবে চিনবেন স্টেরয়েড খাওয়ানো পশু:
এ ধরনের পশু ঠিকমতো হাঁটতে পারবে না, খুব নীরব থাকবে, ঘুম ঘুম ভাব বিরাজ করবে। পশুর উরুর পেশিতে অনেক মাংস থাকবে। গরুর গায়ে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিলে খুব সহজেই তা ধেবে যাবে। কারণ অতিরিক্ত হরমনের কারণে পুরো শরীরে পানি জমে তা মোটা দেখায়। এসব পশু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাই না করলে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অথবা শরীরের মাংস কমে যেতে পারে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বেশি লাভের জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা অতিমাত্রায় হরমন ব্যবহার করে পশু মোটাতাজা করে থাকে। এতে পশুর শরীরের চামড়ার নিচে ব্যাপক পানি জমে। ফলে পশুকে মোটাতাজা দেখায়। এর ফলে গরুর কিডনি, লিভার ও পাকস্থলি নষ্ট হয়ে যায়। এসব পশুর মাংস সেবনকারীর শরীরেও একই রোগ হতে পারে।’



মন্তব্য চালু নেই