‘হিরা চাই না, মানিক্য চাই না, চাইছি তোমার বন্ধুত্ব’

‘বন্ধুত্ব একটি ছাতার ন্যায়। বৃষ্টি যতোই প্রবল হয়, ছাতার ততোই প্রয়োজন হয়’। বন্ধুত্বের ইতিহাস প্রায় মানব সভ্যতারই সমান বয়সী। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই অপূর্ব সম্পর্কটিকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্যই মূলত বন্ধু দিবসের জন্ম।

প্রতি বছর আগস্ট মাসের প্রথম রোববার বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস। আমেরিকাতে ১৯৩৫ সাল থেকেই বন্ধু দিবস পালনের প্রথা চলে আসছে। যতদূর জানা যায় ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটি ছিলো আগস্টের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদে পরের দিন মৃত ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। বিষয়টি সে সময় দারুণ আলোড়ন তোলে। এরপরই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আর তাদের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষ্যেই আমেরিকান কংগ্রেস ১৯৩৫ সালে বন্ধুদিবসের পালনের আইনটি পাশ করেন। আইনে আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে বিশ্ব বন্ধু দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই সূত্রে আগস্ট মাসের প্রথম রোববার এখন বন্ধু দিবস হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দুনিয়া জুড়ে।

১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র ‘উইনি দ্য পোহ’কে ‘ওয়ার্ল্ড এ্যাম্বাসেডর অব ফ্রেন্ডশিপ’ মনোনীত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অনুকরণ বাংলাদেশেও পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব বন্ধু দিবস। আজ আগস্টের প্রথম রোববার, বিশ্ব বন্ধু দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে বন্ধু দিবস হিসেবে এ বছর দিনটি পালিত হচ্ছে ২ আগস্ট।

প্রকৃতির চিরন্তন নিয়মে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে মানুষে-মানুষে, ছেলে-মেয়েতে, ছাত্র-শিক্ষকে, বাবা-মায়ে, পাড়া-প্রতিবেশিতে। জীবনের পথ পরিক্রমায় শৈশব, কৈশোর, ছাত্রজীবন, কর্মক্ষেত্রে, সংসার ও সমাজ জীবনে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে অনেকের সঙ্গে। সুন্দর জীবনের জন্য প্রকৃত ও যোগ্য বন্ধু নির্বাচন একটি সঠিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। ফরাসী কবি জ্যাক দেলিলের (১৭৩৮-১৮১৩) মতে, `নিয়তি তোমার আত্মীয় বেছে দেয়, আর তুমি বেছে নাও তোমার বন্ধু’। বন্ধু নির্বাচনে ভুল করলে জীবনে ছন্দপতন ঘটে। অর্থের বদলে ঘটে যেতে পারে জীবনের সবচেয়ে বড় অনর্থ। তাই, ছেলে মেয়ে প্রত্যেকেরই উচিৎ সঠিক ও যোগ্য বন্ধু নির্বাচন করা।

ছোট্ট একটি শব্দ বন্ধু। এই কথাটির বিস্তৃতি এতটাই যে, কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। বন্ধু বলতে শুধু যে সমবয়সী হতে হবে এমন কোন কথা নেই। মা-বাবার চোখে সন্তানও ভাল বন্ধু হতে পারে, আবার ভাইবোন ও পরস্পরের ভালো বন্ধু হিসেবে নিজেদের মেলে ধরতে পারে।

বর্তমান সময়ে আমরা অনেক ব্যস্ত জীবন যাপন করি। শত ব্যস্ততার মাঝেও মন চায় বন্ধুর হাতে হাত রেখে হাঁটি, মন খুলে জমানো কথাগুলো খুলে বলি বন্ধুদের। তাই বন্ধুকে ঘিরে বছরের এই বিশেষ দিনকে অনেকেই অনেক পরিকল্পনায় সাজিয়েছে। বন্ধুকে সাধ্যের মধ্যে উপহার দেয়া, ঘোরা, আড্ডাবাজি, গান সবকিছুই থাকতে পারে সে পরিকল্পনায়।

বন্ধু তোমার চোখের মাঝে চিন্তা খেলা করে

বন্ধু তোমার কপাল জুড়ে চিন্তালোকের ছায়া

বন্ধু তোমার নাকের ভাজে চিন্তা নামের কায়া…

এই বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে কালজয়ী সব উপন্যাস, উপাখ্যান, সিনেমা, নাটক, গান, মিউজিক ভিডিও, বিজ্ঞাপন চিত্র। বন্ধুত্বের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা থেকে বিখ্যাত জীবনমূখী গানের অন্যতম স্রষ্টা নচিকেতার অণির্বাণ সিরিজের গান আজও আশাজাগানিয়া আর নষ্টালজিয়া হয়ে আছে শত শত বন্ধু সেবকদের কাছে। বন্ধু ছাড়া তাদের কাছে লাইফ ইমপসিবল। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস- বন্ধু থাকলে জিতবে সবাই। প্রতি বছরই বন্ধু দিবসকে সামনে রেখে নতুন নতুন গান ও মিউজিক ভিডিও রিলিজ করছে শিল্পীরা।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, বন্ধুত্ব শব্দটি যুগ যুগ ধরে যে দ্যোতনা নিয়ে স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে আসছে, কালের পরিক্রমায় সে তার জৌলুশ হারিয়েছে। হয়তো বার্ধ্যক্যজনিত কারণে। পৃথিবীর অনেক বয়স, বয়েসের ভারে পৃথিবী ন্যুব্জ। তাই বন্ধুত্ব, ভালোবাসার সম্পর্কগুলোও ধীরে ধীরে তার ইতিহাস, ঐতিহ্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ এরিস্টোটলে’র মতে ‘বন্ধু হল এক আত্মার দু’টি শরীর’।

একমাত্র বন্ধুত্বই এই সংঘাতময় বিশ্ব এবং আত্মকেন্দ্রিকময় সমকালীন বিশ্বকে এক বিনিসূতোর মালায় গাঁথতে সক্ষম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইড্রো উইলসন যথার্থ উপলব্ধি থেকে বলেছিলেন, ‘বন্ধুত্বই একমাত্র সিমেন্ট যা সবসময় পৃথিবীকে একত্র রাখতে পারবে’। আসুন, শুধু দিবস পালনের ভেতরে আমাদের চিন্তাকে সীমাবদ্ধ না রেখে এই তারুণ্যময় সময়ে কাজ করি বন্ধুত্বের কল্যাণে, সাড়া দেই বন্ধুত্বেরই আহ্বানে।



মন্তব্য চালু নেই