হুন্ডির ফাঁদে কমছে প্রবাসী আয়

একটানা দুই বছর ধরেই কমছে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স)। প্রবাসী আয়ের এ নেতিবাচক প্রবণতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ মার্চ মাস শেষে গত নয় মাসের প্রবাসী আয়ে কোনো সুখবর পায়নি বাংলাদেশ। গত অর্থ-বছরের নয় মাসের তুলনায় ১৮৬.৯৬ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৭ শতাংশ কম এসেছে প্রবাসী আয়। টাকার অংকে যা ১৪ হাজার ৯৫৬ কোটি। এ হিসাবে গত নয় মাসে এই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে আসেনি।

অপরদিকে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি বেড়েই চলেছে। কিন্তু এর প্রভাব পড়ছে না প্রবাসী আয়ে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন এতে, টাকার বিনিময়ে ডলার আরো শক্তিশালী হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ও গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত দাঁড়িয়ে আছে প্রবাসীদের পাঠানো টাকার ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই কমতে শুরু করেছে প্রবাসী আয়। চলতি বছরে মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে প্রবাসী আয় কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু নয় মাসের হিসাবে গতবারের চেয়ে কমেছে আয়।

চলতি বছরের মার্চে প্রবাসী আয় হয়েছে ১০৭ কোটি ৭৪ লাখ মার্কিন ডলার। অপরদিকে ২০১৬ সালের মার্চে এসেছিল ১২৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এ হিসাবে গত গত বছরের মার্চের তুলনায় এ বছরে মার্চে প্রবাসী আয় কমেছে ২০ কোটি ৮১ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এটা এক হাজার ৬৬৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। যা শতকরা হিসাবে ১৬.১৮ শতাংশ।

চলতি অর্থ-বছরের প্রথম নয় মাসে (জুন’১৬ -মার্চ’১৭) প্রবাসী আয় এসেছে ৯১৯ কোটি ডলার। গত অর্থ-বছরের একই সময়ে প্রবাসী আয় এসেছিল এক হাজার ১০৫ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। এ হিসাবে নয় মাসে আয় কমেছে ১৮৬ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। যা স্থানীয় মুদ্রায় ১৪ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে যা ১৭ শতাংশ।

ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে মাত্র ৯৩ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ছিল গত পাঁচ বছরে কোনো একক মাসের প্রবাসী আয় হিসাবে সবচেয়ে কম। ২০১১ সালের নভেম্বরের পর এত কম রেমিটেন্স আসেনি এখনো।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অল্প শ্রম দিয়ে বেশি মুনাফা অর্জন করার খাত হলো প্রবাসী আয় থেকে পাওয়া সার্ভিস চার্জ। ফলে একদিকে সরকার এখাত থেকে ভ্যাট বাবদ আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অপরদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মুনাফাও কমছে ধারাবাহিকভাবে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে।

প্রবাসী আয় কমার কারণ জানতে ও করণীয় ঠিক করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ নেয়। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত দুটি প্রতিনিধি দলকে সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যর কয়েকটি দেশ, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল।

সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তারা গিয়ে দেখতে পান, হুন্ডির ফাঁদে আটকা পড়েছে বাংলাদেশের প্রবাসী আয়। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা অর্থ পাঠানোর ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। হুন্ডিতে টাকা পাঠালে খরচ কম। ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বাজারের ডলারের দাম বেশি। হুন্ডিতে টাকা পাঠিয়ে ডলারে ভাঙালে বেশি অর্থ পাওয়া যায়। এ কাজে ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশকে ব্যবহার করে হুন্ডি করছেন প্রবাসীরা। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর প্রবণতা কমেছে।

প্রতিনিধি দল দেশে ফেরত এসে পরামর্শ দিয়েছেন, প্রবাসী আয় পাঠানোর খরচ কমাতে হবে। বাজারের ডলারের দামের সঙ্গে ব্যাংকের ডলারের দামের সামঞ্জস্য রাখতে হবে। প্রবাসীদের অর্থ পাঠানো আরো সহজ করার উদ্যোগ নিতে হবে।

২০১১ সালের নভেম্বর মাসে সর্বনিম্ন ৯০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল। এরপর টানা ৪ বছর অর্থের প্রবাহ বাড়ার পর ২০১৬ সালের শুরুতে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানো কমতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে ২০১৪-১৫ অর্থ-বছরে। সে সময়ে এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলারেরও বেশি আয় এসেছে দেশে।

সূত্র জানিয়েছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব মতে, ২০১৫ সালে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন। পরের বছর ২০১৬ সালে রপ্তানি হয়েছে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ২ লাখ ১ হাজার ৮৫০ জন বেশি গিয়েছেন, যা ৩৬.৩১ শতাংশ বেশি। বিষয়টি স্বীকার করে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী মুহিত পর্যন্ত বলেছেন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রবাসী নিয়োগ হলেও প্রবাসী আয়ে গতি আসেনি।

এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডিকে নিয়ে বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে ব্যাংকগুলোকে প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে চার্জ কমানো ও বিনা চার্জে নেয়া যায় কি-না, প্রবাসীদের প্রণোদনা দেয়াসহ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। কিন্তু এই সুপারিশের কোনো প্রভাব পড়েনি প্রবাসী আয়ে।

এভাবে চলতে থাকলে চলতি অর্থ-বছর শেষে প্রবাসী আয় আরো কমার শঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রবাসী আয় আসলে কতটুকু কমছে আর হুন্ডির মাধ্যমেই বা কতটুকু আসছে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে খুঁজে দেখতে হবে। প্রবাসী আয় কমে যাওয়া ও হুন্ডির মাধ্যমে আসা দুটিই অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। এতে করে ডলারের বিনিময়ে টাকার অবস্থান দুর্বল হবে। আমদানি বাণিজ্যে ব্যয় বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফিতিতে। বেশ কিছু দিন ধরেই মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সেই অবস্থান ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়বে।



মন্তব্য চালু নেই