হুমায়ূন আহমেদ : ‘বাংলা সাহিত্যের পাহাড়াদার’

সাফাত জামিল শুভ : চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচার সামনে সবচেয়ে বেশী ভিড় থাকে। কারন দর্শকরা বানরের অদ্ভুত আচার আচড়ন দেখে মজা পায়। এই দর্শকদের মধ্যে বাচ্চাদের সংখ্যা থাকে বেশী। তারাই মজা পায় বেশী। আসলে আমরা অবচেতন মনে সব সময় ভিন্নতা খুঁজি। সেই ভিন্নতা অস্বাভাবিকতার মাঝেও পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ও শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ নিপুনভাবে মানুষের অস্বাভাবিকতা পাগলামির সাথে উইট এবং হিউমারের সংমিশ্রন ঘটাতে পেরেছিলেন, অস্বাভাবিকতা পাগলামিকে শৈল্পিক আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন আর এভাবেই তৈরী হয়েছে হিমু মিসির আলী বাকের ভাইয়ের মত চরিত্র। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা এসব চরিত্রে বেশী মজা পেয়েছে, অনেকের কাছে এসব চরিত্র আদর্শ হয়ে উঠেছে। হুমায়ুন আহমদের আর একটা সাফল্য- তিনি নিজে, তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো এবং অগনিত ভক্তকূলকে নিয়ে নিজস্ব একটা ভুবন বা পরিমন্ডল গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।

হুমায়ূনের বড় কৃতিত্ব এখানেও নয়, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তিনিই প্রথম এবং একমাত্র লেখক যিনি পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার লেখক কবি সাহিত্যিকদের জন্য এদেশের বাজার সংকুচিত করে ফেলেছিলেন। বিভাগপূর্ব বাংলায় কলকাতা ছিল ব্যবসা বাণিজ্য অর্থনীতি সাহিত্য সংস্কৃতির একমাত্র পীঠস্থান। ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা শুধু বাংলা নয় ছিল সমগ্র বৃটিশ ভারতের রাজধানী। এর আগে মাত্র ছয় বছর ঢাকা হয়েছিল পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশের রাজধানী। এ সময় শিক্ষাদীক্ষা ব্যবসা বাণিজ্যের দিক থেকে রাজধানী ঢাকা কিছুটা সমৃদ্ধ হতে পারলেও সাহিত্য সংস্কৃতি রয়ে গেছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যাওয়ার পর সব কিছু আবার আবার কোলকাতাকেন্দ্রিক কায়েমী স্বার্থবাদীদের করতলগত হয়। এই চক্রটি এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করতেও দ্বিধা করে নাই। সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনের কলকাতাকেন্দ্রিক এই কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীটি সব সময়ই রাজধানী ঢাকা’কে দেখে এসেছে তাদের পণ্য বা বইয়ের বাজার হিসাবে। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে গান্ধী নেহেরু প্যাটেল জ্যোতি বসুরা বাংলা ভাগ করে এক অংশকে ভারতের সাথে মিলিয়ে দেয়ার পরও আমাদের দেশ রয়ে গিয়েছিল কলকাতার কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবিদের অবাধ চারণভূমি। এতদসত্বেও একটি নতুন স্বাধীন দেশের অংশ হিসাবে পূর্ব বঙ্গেও নিজস্ব সাহিত্যকর্ম শুরু হয়। কলকাতার মানিক বন্দোপাধ্যায় বনফুল মহাশ্বেতা দেবী শংকরদের মত লেখকদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশেও ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, হাসান হাফিজুর রহমান, সিকান্দার আবু জাফর, সৈয়দ আলী আহসান ফররুখশিয়র, বন্দে আলী মিয়া, ড: আশরাফ সিদ্দিকী প্রমূখের মত লেখক কবি সাহিত্যিকদের উন্মেষ ঘটতে থাকে।

১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা ছিল কলকাতার বই পুস্তক পত্রপত্রিকার জন্য অবারিত বাজার। কলকাতায় প্রকাশিত সে দেশের লেখকদের বই পুস্তক পাঠকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল এদেশে। এ দেশের এক শ্রেণীর লেখক কবি-সাহিত্যিকদের জন্য কলকাতা হয়ে ওঠে তীর্থভূমি।একপ্রকার “মানসিক দাসত্বের” জালে বন্দী ছিলেন তারা। এই সুযোগে কলকাতার লেখক কবি সাহিত্যিকরাও এদেশে তাদের হারানো বাজার পুন:প্রতিষ্ঠা করে নেয়। এক সময় দেখা যায় কলকাতার তৃতীয় শ্রেণীর লেখকের বইও নকল হয়ে বাজারে বিক্রি হচ্ছে।

হুমায়ুন আহমদ কলকাতার লেখক কবি সাহিত্যিকদের এই অবাধ এবং নিরুপদ্রুত বাজারে ”ঝড়” হয়ে আবির্ভূত হন। লন্ডভন্ড হয়ে যায় কায়েমী স্বার্থের সাজানো বাগান। সাধারন পাঠকরা ভারতীয় লেখকদের থেকে বাংলাদেশের লেখকদের দিকে ফেরেন। বাজারে ভারতীয় লেখকদের বই বিক্রির হার হু হু করে নেমে যায়। আতংকিত হয়ে ওঠেন লুটেরা কায়েমী স্বার্থবাদীরা। এদেরকে ‘ভাতে মারায়’ হুমায়ুন হয়ে ওঠেন এই গোষ্ঠীটির চক্ষুশূল। এরাই ছিলেন হুমায়ুনের সবচেয়ে বড় সমালোচক। এরাই হুমায়ুনের উপন্যাসকে বলতেন ‘অপন্যাস’। এই তল্পিবাহক সারমেয় চরিত্রের লোকগুলোর কাছেও হুমায়ুন ছিলেন একজন ‘অপলেখক’।

তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ আমাদের দেশ। এদেশের নিজস্ব সাহিত্যাঙ্গনের দরজায় পাহাড়াদার আর কেউ থাকলো না। শংকা এই- কলকাতাওয়ালারা না বাজারটা আবার দখল করে নেয়, আবার না ঢাকায় তাদের রামরাজত্ব শুরু হয়ে যায়! একমাত্র হুমায়ুনই পেরেছিলেন ওদেরকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে, আর কেউ কি হুমায়ুন হয়ে উঠে আসতে পারবেন!

হুমায়ুন ছিলেন প্রচুর রসবোধের অধিকারি এক মানুষ। উইট হিউমারকে উপজীব্য ধরে তিনি নাটক চলচ্চিত্র গল্প উপন্যাসে পাঠককে মজা দিয়েছেন। তার অধিকাংশ চরিত্রই মূলত: অপ্রকৃতিস্থ। খানিকটা অস্বাভাবিক পাগলাটে ধরনের। এদের আচাড় আচরন কথাবার্তা চলন বলন স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্ন। হয়তো তিনি দেখাতে চেয়েছেন সমাজে বসবাসকারী মানুষগুলো সকলেই কোন না কোন দিক দিয়ে অস্বাভাবিক অপ্রকৃতিস্থ। আমরা মানুষের এই অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারিনা। হুমায়ুন এই বিষয়গুলোকে পিনপয়েন্ট করে সামনে তুলে ধরেছেন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে নন্দিত নরকে শঙ্খনীল কারাগার, এইসব দিন রাত্রি, জোছনা ও জননীর গল্প, মন্ত্রসপ্তক, দূরে কোথাও, সৌরভ, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরীপুর, জংশন, বহুব্রীহি, লীলাবতী, কবি, নৃপতি, অমানুষ, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, বৃষ্টি ও মেঘমালা, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, আমার আছে জল, আকাশ ভরা মেঘ, মহাপুরুষ, শূন্য, ওমেগাপয়েন্ট, ইমা, আমি এবং আমরা, কে কথা কয়, অপেক্ষা, পেন্সিলে আঁকা পরী, অয়োময়, কুটুমিয়া, দ্বিতীয় মানব, ইস্টিশন, মধ্যাহ্ন, মাতাল হাওয়া, শুভ্র গেছে বনে, ম্যাজিক মুনসি, ময়ূরাক্ষী, হিমু, হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম, হলুদ হিমু কালো র্যাব, আজ হিমুর বিয়ে, হিমু রিমান্ডে, চলে যায় বসন্তে দিন, আমিই মিসির আলি, যখন নামবে আঁধার ইত্যাদি।

আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বলপয়েন্ট, কাঠপেন্সিল, ফাউন্টেইনপেন, রং পেন্সিল, নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ। চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত সার্থক সৃষ্টি শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারি, চন্দ্রকথা, আগুনের পরশমণি ও শ্যামল ছায়া।

হুমায়ূন আহমেদ প্রচুর টিভি নাটক লিখেছেন। এরমধ্যে তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায় টিভি সিরিয়াল এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার প্রভৃতি। এছাড়াও তার অনেক খণ্ড নাটক একাঙ্কিকা, একক নাটক টিভিতে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ তার ওপরে কেউ নেই বিশেষত কথা সাহিত্য ও নাটক সিনেমায়। অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ নাটক কথসাাহিত্য তিনি রচনা করেছেন। তিনি আমাদের সমাজকে ফাঁকি দেননি। সমাজ সংসার বাস্তবতা নিয়েই তিনি লিখেছেন। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মুসলিম সমাজের বাস্তবজীবন অত্যন্ত রসালো করে জীবননিষ্ঠ করে ফুটিয়ে তুলেছেন তার গল্প, নাটক ও উপন্যাসে।

হুমায়ূনে আহমেদের জনপ্রিয়তা এবং শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের কথা সাহিত্যিক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা কত ছিল সবারই জানা। আমাদের দেশে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এক সময়ের যে জনপ্রিয়তা ছিল তাকেও হুমায়ূন ছাড়িয়ে গেছেন। হুমায়ূন আহমেদ সত্যিই একজন বড় লেখক। বাংলা ভাষার গর্ব আমি তাই মনে করি।’

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দু সমাজের ভেদনীতি, বিধবা গঞ্জনা, নারী নির্যাতন, শ্রেণী বৈষম্য প্রভৃতি সমাজ বাস্তব বিষয়ে লিখেছেন। হিন্দু সমাজের নারী সমাজের প্রগতির কথা বলেছেন সাধারণ মানুষের সুখদুখের কথা বলেছেন অত্যন্ত সফলভাবে।

হুমায়ূন আহমেদ তদ্রুপ লেখক সমাজ কর্তৃক অনাদৃত, অনুল্লেখ্য, বিপুল বিশাল মুসলিম সমাজকে প্রধান উপজীব্য করেছেন। মুসলিম সমাজপতির সমাজ পরিবার সংস্কার ভালো কর্ম করা, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সুখদুঃখ তার লেখায় প্রধান হয়ে ওঠেছে। সাধারণ পাঠকেরা তাদের জীবনের কথা তার লেখার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে। লেখার কথাগুলো বাক্যগুলো অত্যন্ত তীর্যকভাবে বর্ণনা হওয়ায় পাঠকেরা তা সহজে গ্রহণ করেছে। অত্যন্ত সহজ সরলভাবে অথচ রসে ভরা, দর্শনে ভরা তার লেখা পাঠকেরা দারুণভাবে গ্রহণ করেছে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস, গল্প ও নাটকে ছিল ধর্মপ্রাণ মুসলিম মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সুখদুখের সরস বর্ণনা। কোথাও ভাঁড়ামি, নোংরামি, অশ্লীলতা, মিথ্যা ও অবাস্তবতা ছিল না তার গল্পের চরিত্রগুলোতে। ছিল না ধর্মের প্রতি কটাক্ষ বরং কোথাও কোথাও অত্যন্ত বাস্তবভাবে ধর্মজীবনের আলোকপাত রয়েছে। নর-নারীর প্রেম ভালোবাসাও তার গল্পে স্থান পেয়েছে কিন্তু তাতে নেই অযথা সেক্স ভায়োলেন্স।তাঁকে কেউ কেউ অযাথা অতি আধুনিক ধর্মহীন বলার প্রয়াস পেয়েছে। কিন্তু তিনি ছিলেন আস্তিক লেখক। তিনি নাস্তিক ছিলেন না। ধর্মকে আক্রমণ করে কিছু লেখেননি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি অতিবাস্তব উপন্যাস রচনা করেছেন।হয়তো প্রথাবিরোধী ছিলেন, কিন্তু ধর্মকে আঘাত করেননি তিনি।তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাতকারে বিষয়টি স্পষ্ট।

হুমায়ুন আহমদ আর দ্বিতীয়টি জন্ম নেবেনা তবে হুমায়ুনের কাজ অর্জন সাফল্যগুলোকে যদি ধরে রাখা যায়, তার মত করে পাঠক তৈরী করা যায় তাহলেই কেবল সাহিত্যাঙ্গনে কলকাতার আগ্রাসন রুখে দেয়া সম্ভব হবে।বর্তমানকালে নাটক থিয়েটার সঙ্গীত চিত্রকলায় বাংলাদেশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বলে আর কিছু নাই। এসব ক্ষেত্রে বিজাতীয় বা পশ্চিমবঙ্গীয় ভাবধারা ষোল আনা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে,শুধু সম্ভব হয়নি সাহিত্যাঙ্গনে। হুমায়ূন আহমেদই মেধা ও যোগ্যতা ঠেকিয়ে রেখেছিলেন অপসংস্কৃতির কালো থাবা।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



মন্তব্য চালু নেই