হ্যাকিংয়ে ডেপুটি হাইকমিশনের অর্থ চুরি

এবার পাকিস্তানের করাচিতে অবস্থিত বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের ইমেইল হ্যাক করে প্রায় ৩৪ হাজার ইউরো (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৯ লাখ টাকা) হাতিয়ে নিয়েছে হ্যাকাররা। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদুল হক অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিবকে চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি জানিয়ে অর্থ উদ্ধারে পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এর আগে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ভুয়া সুইফট বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি করে হ্যাকাররা। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ওই অর্থ চুরির ঘটনার এক বছর পার হলেও মাত্র দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করতে পেরেছে বাংলাদেশ।

এদিকে, ডেপুটি হাইকমিশনের ইমেইল হ্যাক করে ৩৪ হাজার ইউরো চুরির পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠি এবং অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো চিঠি দুটির অনুলিপি জাগো নিউজের কাছে রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ নিয়মে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই অর্থ উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পররাষ্ট্র সচিবের চিঠিতে বলা হয়েছে, করাচির বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে ‘ফ্ল্যাগ কার’ হিসেবে ব্যবহারের জন্য জার্মানি থেকে মার্সেডিজ বেঞ্জ ব্র্যান্ডের একটি গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী বার্লিনের ডাইমলার এজি স্টুইটগার্ট (Daimler AG Stuttgart) নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্রয় চুক্তি করা হয়। ওই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে করাচির ডেপুটি হাইকমিশন ৪০ হাজার ইউরো বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাসের ব্যাংক হিসেবে পাঠায়।

চুক্তি মোতাবেক ২০১৬ সালের অক্টোবরে গাড়ির মোট মূল্যের ১৫ শতাংশ করাচির বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাস বার্লিনে অবস্থিত ডুয়েশ্চে ব্যাংক এজি স্টুইটগার্টের (Deutsche Bank AG Stuttgart) ব্যাংক হিসাবে পাঠায়।

ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর অবশিষ্ট অর্থ অর্থাৎ ৩৪ হাজার ১১ ইউরো পরিশোধের জন্য করাচির বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারকে অনুরোধ জানানো হয়। একই সঙ্গে গাড়িটি ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হস্তান্তর করার কথাও জানায় গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

ওই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে একই দিনে করাচির বাংলাদেশ দূতাবাস হতে ইমেইলের মাধ্যমে বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাসকে বাকি অর্থ ব্যাংক এজি স্টুইটগার্টের ব্যাংক হিসাবে পাঠাতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু সে সময় তিনদিন বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাস বন্ধ থাকায় ওই অর্থ পাঠানো সম্ভব হয়নি।

এরপর ১৯ ডিসেম্বর করাচির ডেপুটি হাইকমিশনারের ব্যক্তিগত ইমেইল থেকে বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করা হয়। এতে বলা হয়, আরেকটি ইমেইলের মাধ্যমে বাকি অর্থ পূর্বের ব্যাংক হিসাব নম্বরে না পাঠিয়ে নতুন একটি ব্যাংক হিসাব নম্বরে পাঠাতে অনুরোধ করা হয়। কারণ হিসেবে জানানো হয়, অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক আগের হিসাব নম্বরটি নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে ওই হিসাব নম্বরে অর্থ গ্রহণ করা আপাতত সম্ভব নয়। ফলে বাকি অর্থ ম্যানচেস্টারের ন্যাটওয়েস্ট ব্যাংকের (Natwest Bank) একটি হিসাব নম্বরে জমা দিতে বলা হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত বাকি অর্থ ন্যাটওয়েস্ট ব্যাংকের হিসাবে জমা দেন। তিনি একই দিন অর্থ জমা দেয়ার প্রমাণ হিসেবে ব্যাংক থেকে পাঠানো ‘কনফারমেশন স্লিপ’ করাচির ডেপুটি হাইকমিশনারকে ইমেইলের মাধ্যমে পাঠান। কিন্তু ওই ইমেইলটিও হ্যাক হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কারণ, যে কনফারমেশন স্লিপটি ডেপুটি হাইকমিশনার পান, তাতে ১৫ ডিসেম্বর যে ব্যাংক হিসাব নম্বর দেয়া হয়েছিল সে অনুযায়ী অর্থ পাঠানো হয়েছে বলে দেখানো হয়। ফলে এটি বোঝার উপায় থাকে না যে, ওই অর্থ ম্যানচেস্টারে অবস্থিত ন্যাটওয়েস্ট ব্যাংকের হিসাব নম্বরে পাঠানো হয়েছে।

পরবর্তীতে জানা যায়, ১৯ ডিসেম্বর করাচির ডেপুটি হাইকমিশনারের নামে বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাসে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে পাঠানো ইমেইলটি প্রকৃতপক্ষে করাচির ডেপুটি হাইকমিশনার পাঠাননি। ধারণা করা হচ্ছে, ডেপুটি হাইকমিশনারের ইমেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ওই বার্তা পাঠানো হয়। বিষয়টি তিনি নিজে ও বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাসের কেউই অবহিত ছিলেন না।

এদিকে কনফারমেশন স্লিপটি পাওয়ার পর ডেপুটি হাইকমিশনার গাড়ি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন এবং অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানান।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে বারবার ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি গত ২০ জানুয়ারি ডেপুটি হাইকমিশনারকে জানান, যে কনফারমেশন স্লিপটি পাঠানো হয়েছে তা জাল। এছাড়া যে ব্যাংক (ন্যাটওয়েস্ট ব্যাংক) হিসাবে অর্থ পাঠানো হয়েছে সেই ব্যাংক হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো লেনদেন হয় না।

বিষয়টি অবগত হওয়ার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাসকে স্থানীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে অর্থ উদ্ধারে তাদের সহযোগিতা চাইতে নির্দেশনা দেয়।

এছাড়া যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও ম্যানচেস্টারে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনকে ওই অর্থ আদায়ের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। তাছাড়া বার্লিন ও ম্যানচেস্টারের বাংলাদেশ মিশনকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে এ ঘটনায় ‘পুলিশ কেস ফাইল’ করার নির্দেশ দেয়া হয়।

চিঠিতে আরও বলা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অর্থ চুরির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। পাশাপাশি এর কারণ উদঘাটনে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মিশনপ্রধানদের লিখিত বক্তব্য জানাতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিদেশের সব বাংলাদেশ মিশনকে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখবে জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অনুরোধ জানিয়েছে।

ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর একটি নির্দেশনা পাঠিয়েছেন। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার অতিরিক্ত কী করা যায় তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ ও করণীয়সহ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ভুয়া সুইফট বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের রিজল ব্যাংকে পাঠায় হ্যাকাররা। ওই অর্থ পরে জুয়ার টেবিলে চলে যায়।

রিজার্ভের সবচেয়ে বড় ওই অর্থ চুরির ঘটনায় পরে ফিলিপাইনের সিনেট কমিটি তদন্ত শুরু করে। একপর্যায়ে দেশটির এক ক্যাসিনো মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধারের পর তা ফেরত পায় বাংলাদেশ। এছাড়া রিজার্ভের ওই অর্থের আরও ২ কোটি ৭০ লাখ ডলার জব্দ করে ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ। তবে বাকি অর্থ এখনো ফেরত পায়নি বাংলাদেশ।



মন্তব্য চালু নেই