২২ দিন বন্ধ ফেসবুক নিয়ে যতো কাণ্ড

‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ ২২ দিন ফেসবুক বন্ধের পর থেকে সরকারের পক্ষ ফেসবুক বন্ধের স্বপক্ষে নানা যুক্তি-উদাহরণ দিচ্ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন, টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির পর নাশকতা রুখতে, প্যারিস হামলার উদাহরণ টেনে ফেসবুক বন্ধের যৌক্তিকতা প্রমাণে ব্যস্ত ছিলেন তারা।

ইন্টারনেট গেটওয়েতে ফেসবুক বন্ধ করলেও জনগণের ফেসবুক ব্যবহারে কোনো সরাসরি নিষেধাজ্ঞা না থাকায় বিশেষায়িত ব্রাউজার-প্রক্সি দিয়ে ফেসবুক ব্যবহার করে ফেসবুক বন্ধে সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিলেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশিষ্ট ব্যক্তি-তারকারা।

এর মধ্যেই ফেসবুকের সঙ্গে চুক্তি করতে সরকারের তরফ থেকে চিঠি পাঠান টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী। নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তি ও সরকারের কথা শুনতে বৈঠক করতে ইতিবাচক সাড়া দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রী যখন যে আয়োজনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন তখনই তাদেরকে ফেসবুক কেনো বন্ধ, কবে খুলবে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান নিরাপত্তার স্বার্থে ফেসবুক বন্ধ আছে, সময় হলেই খুলে দেয়া হবে বলে জানান। একই কথা বলেন টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীও। জনগণের স্বার্থেই সামাজিক মাধ্যম বন্ধ আছে বলে জানান তিনি।

এক পর্যায়ে সাধারণ জনগণের একচেটিয়া সমালোচনার জবাব দিতে জনগণের উদ্দেশ্যে ‘খোলা চিঠি’ লিখে গণমাধ্যমে পাঠান টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। তবে এতেও সমালোচনা থামেনি। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বিকল্প উপায়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ফেসবুক বন্ধের সমালোচনা করেন অনেকেই।

ফেসবুক বন্ধ করায় প্রতিক্রিয়া ছিলো ব্যবহারকারীদের
নাশকতা ঠেকাতে ফেসবুক বন্ধ করার যৌক্তিকতা নিয়ে শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ লিখেছিলেন, ‘ফেসবুক বন্ধ করে যদি নাশকতা ঠেকানো যেতো তবে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ বহু আগেই আইএসকে থামাতে ফেসবুক বন্ধ করে দিতেন। প্রযুক্তি আটকে দিয়ে নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব হলে গুগলও অনেক আগেই ইউটিউব বন্ধ করে দিতো। আর সেখানে ফেসবুক ব্যবহারতো পুরোপুরি বন্ধও করা যাচ্ছে না।’

শাওন মাহমুদ হতাশার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমি একজন সাধারণ গৃহিণী হয়েও যদি এতো সহজে ফেসবুক ব্যবহার করতে পারি, তবে যারা তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখে তাদের কাছে তো ফেসবুক চালানো কোনো বিষয়ই না। এটা আসলে একটা লোক দেখানো ব্যাপার’।

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার সরকারের নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেসবুক ব্যবহারে বিরত ছিলেন। তবে সরব ছিলেন বন্ধের প্রতিবাদে। তিনি বলেছিলেন, ‘মাথাব্যথা হলে তো আর আপনি মাথা কেটে ফেলবেন না। তাহলে ফেসবুক ব্যবহার করে নাশকতা করার চেষ্টা করলে ফেসবুক কেনো বন্ধ করতে হবে? বরং সেই নাশকতার চেষ্টা বন্ধ করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে যেনো নাশকতার কাজে তারা ফেসবুক ব্যবহার না করতে পারে। পুরো সিস্টেম বন্ধ করলে তো চলবে না।’

ফেসবুক খোলার দাবিতে রাজপথে
টানা বন্ধে ফেসবুক কেন্দ্রীক ই-কমার্স সাইট, অনলাইন সংবাদমাধ্যম সহ অনেক পক্ষ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।

gwIO9KH3yuZp

বাধ্য হয়ে রাস্তায় ব্যানার প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির হন অনেকেই।

ot5qI28hKaLC

মানববন্ধন, সমাবেশ হয়েছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও।

সমালোচনার জবাবে সরকার
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন,‘একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থেই এটা করা হয়েছিলো। ফেসবুকের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা যখন মনে করবো এটার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দেয়ার সময় হয়েছে তখনই উঠিয়ে দেবো’।

১ ডিসেম্বর চ্যানেল আই প্রাঙ্গনে ব্যান্ড ফেস্টে এসে টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, ‘একদিকে মানুষের জীবন, অন্যদিকে ফেসবুক- আপনারাই বলুন কোনটিকে আপনারা বেছে নেবেন? আমি মনে করি, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কিছু অ্যাপস থেকে মানুষের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। মানুষের জীবনের স্বার্থে সরকারকে সবার সহযোগিতা করা উচিত। ছোট্ট একটা অ্যাপসের বিষয়ে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করব না- এমন এমন সংকীর্ণ মানসিকতার নয়, এটা আমার বিশ্বাস।’ তিনি এ সময় ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের জনগণের সহনশীলতার উদাহারণ দিয়েছিলেন।

ফেসবুকের সঙ্গে বসলো সরকার
টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর চিঠি পেয়ে ঢাকায় আসা ফেসবুকের সাউথ এশিয়ার পাবলিক পলিসি ম্যানেজার দিপালী লিব্রানের সঙ্গে সচিবালয়ে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।

বৈঠকে ফেসবুকের সঙ্গে সরকারের তথ্য প্রাপ্তি ও আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা হয়। র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইং প্রধান কর্নেল জিয়েউল আহসান বৈঠকে যোগ দেন ওই বৈঠকে।

বৈঠকে বাংলাদেশে ফেসবুকের নানা ধরনের অপব্যবহার ও নেতিবাচক বিষয়গুলো ফেসবুক প্রতিনিধিদের কাছে তুলে ধরা হবে। তাদের কাছে কোনো বিষয়ে অভিযোগ করলে যাতে দ্রুত সাড়া পাওয়া যায় তার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আলোচনায়। এসব বিষয়ে ফেসবুকের সঙ্গে চুক্তি করতে চায় বাংলাদেশ। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য পাওয়া সম্পর্কিত একটি চুক্তি সইয়ের বিষয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে। এছাড়া, বাংলাদেশে ফেসবুকের অ্যাডমিন রাখার বিষয়েও ফেসবুক প্রতিনিধিদের অনুরোধ জানায় সরকার।

অবশেষে খুলেছে ফেসবুক
১৮ নভেম্বর থেকে তিন সপ্তাহ বন্ধ রাখার পর অবশেষে ১০ ডিসেম্বর ফেসবুকে ঢোকার গেটওয়ে খুলে দিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে এ ব্যাপারে মোবাইল অপারেটরদের ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেসবুক খুলে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলে তারা ফেসবুকে ঢোকার পথে বাধাগুলো সরিয়ে নেন।তবে নিরাপত্তার স্বার্থে পরবর্তী নির্দেশ দেয়ার আগ পর্যন্ত ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপে ঢোকার গেটওয়েগুলো বন্ধ থাকবে।-চ্যানেলআই



মন্তব্য চালু নেই