৩৯ বছর পর হারানো মা-মেয়ের মিলন, অশ্রুসিক্ত একটি মুহূর্ত

অভাবের তাড়নায় মানুষ কি না করে। নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার ঘটনা নতুন নয়। বেশ কিছু নজিরও আছে এ রকম। সন্তানকে ফেলে যাওয়ার নজিরও কম নেই। খুঁজলেই মিলে যাবে ভূরি ভূরি। কিন্তু সেই সন্তানই বড় হয়ে যদি তার জন্মদাত্রী মাকে খুঁজে বের করে, অবশ্যই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নয়, মাকে কেবল মা বলে ডাকার জন্য, মায়ের কোলে আশ্রয় নেয়ার জন্য। তাহলে সেই সন্তানকে বড় মনের মানুষ বলতেই হয়।

মাও বা কম কিসে।

সন্তানকে ফেলে দেয়ার কী যে কষ্ট, কী যে যন্ত্রণা, ৩৯ বছর ধরে নিরন্তর ক্ষতবিক্ষত করছিল তার অন্তর, যে যেন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি বাস্তবতার কাছে হার মেনে। পরিবর্তিত জীবনের হাত ধরে এখন পাল্টে গেছে তারও সংসার। কিন্তু কখনো ভোলেননি তার ফেলে দেয়া মেয়ের কথা। নিরন্তর খুঁজে বেড়িয়েছেন তাকে। শেষমেষ পেয়ে গেলেন অপ্রত্যাশিতভাবে।

মা-মেয়ের এই রকম মিলনের ঘটনা ঘটেছে কিনা, কারো জীবনে, তা জানা নেই, ঘটে থাকলেও তা অত্যন্ত বিরল।

বিরল এই ঘটনাই ঘটেছে চীনের পূর্বঞ্চলীয় শহর রুইয়ানে। ৩৯ বছর পর প্রচণ্ড আবেগঘন মিলন ঘটে মা ও মেয়ের।

শহরের একটি এতিমখানার ফটকের ঠিক সামনে ১৯৭৭ সালে ফেলে রাখা হয়েছিল তিনদিনের শিশু লিউ জিউরংকে। এখন তার বয়স ৩৯। তার মার নাম চেন জিনমেই, ৭০ বছরের কাছাকাছি তার বয়স।

মা-মেয়ের মিলনের পরই তারা জানতে পারলেন খুব দূরে ছিলেন না, তারা ছিলেন একেবারে কাছাকাছি। আধা কিলোমিটারের মধ্যে।

ছবি দেখে জানা যায়, কতোটা আবেগঘন ছিল তাদের মিলন। অঝোর ধারায় কাঁদছেন তারা দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে। চেন জিনমেইয়ের কান্নাটা যেন বেশি। দমকে দমকে কাঁদছেন তিনি মেয়েকে অত্যন্ত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেন আর কখনোই ওভাবে ফেলে যাবেন না তার মেয়েকে। মাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে মেয়েও একেবারে ভেঙে পরেন, কান্নায়।

আবেগঘন এই মুহূর্তে চেনের অন্য মেয়েরাও ছিলেন কাছেই। তারাও পানি সামলে রাখতে পারছিলেন না তাদের চোখের।

লিউ যখন জন্ম নেন, তখন চেনের পরিবারে ছিল চার মেয়ে। অভাব-অনটনও এতটাই চরমে পৌঁছেছিল যে দিনই কাটছিল না তাদের। ফলে তারা তাদের পঞ্চম মেয়েকে শহরের এতিমখানার বাইরে ফেলে রাখার এই ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নেন।

দত্তক হিসেবে আশ্রয় পাওয়ার আগ পর্যন্ত জিউরংকে এতিমখানায় থাকতে হয়েছে প্রায় দুই মাস। তাকে দত্তক নেন পাশের জেলা ওয়েনচেংয়ের একটি পরিবার।

যে পরিবারটি তাকে দত্তক নেন সেই পরিবারে কোনো সন্তান ছিল না। একটি সন্তান হয়েছিল। কিন্তু মারা যায় জন্মের পরপরই।

দত্তক পরিবার সম্পর্কে লিউ জিউরং বলছেন, ‘তাদেরও আর্থিক অবস্থা তখন খুব একটা ভাল ছিল না। দত্তক নেয়ার পরপরই তাদের দু’জনের জমজ কণ্যা সন্তান জন্ম নেয়। তারপরও তারা তার সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করেননি। এমন কি, উচ্চ স্বরে কথা পর্যন্ত বলেননি।’

দত্তক বাবা-মা কোনো কথাই গোপন করেননি। এমন কি, তিনি যে দত্তক সে কথাও গোপন করেননি। সব কথাই তাকে বলেছেন খোলামেলা। তবে নয় বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত নয়, তখনই তিনি প্রথম জানতে পারেন তারা তার আসল বাবা-মা নন।

লিউ-এর বয়স যখন ১১, তখন তারা দত্তক মা মারা যান। সেই সময় তাদের আর্থিক অবস্থা এতোই খারাপ হয়ে যায় যে, পরিবারের ভরণপোষণ করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তার দত্তক বাবা। তাই ১৬ বছর বয়সে কাজ করে খাওয়ার সিদ্ধন্ত নেন তিনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান কাজের সন্ধানে।

কিন্তু লিউ-এর অন্তরে সব সময় ছিল নিজের মাকে খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছা। নিজের সম্পর্কে যা তথ্য তার জনা ছিল, তার সবই তুলে ধরেন তিনি স্থানীয় একটি পত্রিকায়। এভাবে তিনি কয়েকজনের সঙ্গে পরিচিতও হন। কিন্তু এটা কোনো কাজে আসে নি। সব উদ্যোগই ব্যর্থ হয়ে যায়।

এদিকে লিউ-এর খোঁজ করতে থাকেন তার বোনরাও। উ জিউপিং বলেছন, ‘কয়েক বছর ধরে আমরাও তাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু একই ধরনের সমস্যায় আমাদেরও পড়তে হয়। ব্যর্থ হয় সব উদ্যোগ।’

‘এরপর একদিন আমাদের এক প্রতিবেশী এসে জানান যে, তিনি পত্রিকায় একটি ছবি দেখেন, যিনি তার জন্মদাত্রী মার খোঁজ করছেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন না যে আমরা একই রকম দেখতে,’ বলেন উ জিউপিং।

তবে অবশেষে মিলনাত্মক নাটকের দিকে গড়ায় পুরো ঘটনাটি।

উ জিউপিং ২১ জুন পত্রিকায় লিউ-এর ছবি দেখেন। তার মনে হয়, তিনি তার হারানো বোন হতে পারেন। উ পত্রিকাটির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখানে লিউ-এর সঙ্গে দেখা হয় প্রথমবারের মতো।

এরপর ২৪ জুন চেন ও লিউ- এর ডিএনএ টেস্ট করা হয়। পরীক্ষার ফলাফল যেদিন দেয়ার কথা, তার আগের রাতে লিউ একেবারে ঘুমাতে পারেননি বলে জানান। তিনি বলছেন, ‘সারারাত কাটে তার বিছনায় শুয়ে শুয়ে।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন লিউ ৮ জুলাই। তারা নিশ্চিত হন, চেনরই সন্তান লিউ। ৩৯ বছর পর অপেক্ষার অবসান ঘটে মা ও মেয়ে, দু’জনেরই।

এরপর সব মিলনাত্মক নাটকে যেমনটা ঘটে থাকে, ঠিক সেমনটা ঘটতে থাকে লিউ ও চেনের জীবনে।

সূত্র: ডেইলি মেইল।



মন্তব্য চালু নেই