৪০০ বছরের বেদে নামক ইতিহাস মুছে দিলেন এস পি হাবিবুর রহমান!

মানুষ মানুষের জন্য, মাত্র একজন মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বদলে যেতে পারে কোন অবহেলিত জনপদের জীবনযাত্রা। ঘুরে দাঁড়াতে পারে যুব ও তরুণ সমাজ। মহিলারা হতে পারেন সাবলম্বী। ইচ্ছা থাকলে যুগ যুগ ধরে অবহেলিত হলেও নিজ প্রচেষ্টায় কর্মক্ষম মানুষ গাইতে পারে জীবনের জয়গান। এ চিত্র সাভার বেদেপল্লীর।

ঝাড়ফুঁক, সিংগা লাগানো, দাঁতের পোকা ফেলা, সাপ পালন ও বিক্রি এবং মাদক ব্যবসা যে এলাকার চিরচেনা রুপ ছিল সেই বেদেপল্লীতে দিন বদলে ছোয়া লেগেছে। থেমে গেছে নিজেদের মধ্যকার বিবাদ। বন্ধ হয়েছে বহুবিবাহ। জীবনমান বদলে যাওয়ায় ওই এলাকায় ঘরে ঘরে এখন কর্মক্ষম মানুষ। একসময়ের অলস মানুষগুলোর এখন কর্মব্যস্ত জীবন।
যুগ যুগ ধরে অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত বেদেপল্লীর চালচিত্র বদলে দেয়ার অসাধ্যকে সাধন করেছেন পুলিশের একজন কর্মকর্তা। তার নাম হাবিবুর রহমান, যিনি ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার। পুলিশ নিয়ে অনেকের বিরুপ ধারনা থাকলেও হাবিবুর রহমান এর ব্যতিক্রম। তিনি তার আন্তরিকতা ও কর্মের মধ্যদিয়ে পাল্টে দিয়েছেন একটি জনপদের চেহারা। সার্বক্ষনিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে তিনি ওই এলাকায় গড়ে তুলছেন কর্মক্ষম নারী-পুরুষ।

জানা গেছে, সাভার থানায় বেদে সম্প্রদায়ের মধ্য মারামারীর অভিযোগ প্রায়ই মিলে। বিশেষ করে ওই এলাকায় মাদকের ভয়াবহতা রয়েছে। ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ সবধরনের মাদক মিলতো হাত বাড়ালেই। এ অবস্থায় পুলিশ মাদকবিরোধী অভিযানে নেমে এরসঙ্গে নারী পুরুষের সম্পৃক্ততা পায়। পুলিশ সুপার (এসপি) বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে তাদের পূনর্বাসনের উদ্যোগ নেন। এরপর শুরু হয় ধারাবাহিক কর্মসূচী। এরমধ্যে মারা যাওয়ার পর বেদেদের কবরস্থান সমস্যা সমাধান ও শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি নিশ্চিত করতে স্থানীয়ভাবে গড়ে তুলেন জনমত। বেদেরা নাগরিক সুবিধা পেতে শুরু করলে তারা এসপির উপর আস্থাশীল হয়। এরপর তাদের পূনর্বসানের উদ্যোগ শুরু হয়।

অমরপুর, পোড়াবাড়ি, কাঞ্চনপুর ও বক্তারপুর এলাকা নিয়ে ‘সাভার বেদে পল্লী’। সেখানে ২০ হাজারেরও বেশি বেদের বসবাস। মূলত সাপ নিয়েই কারবার তাদের। এক সময় নৌকায় বসবাস করলেও এখন গৃহস্থের মতো ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন বেদেরা। সাপ ধরে বিক্রি করা, সাপের রকমারি খেলা দেখানো, সিঙ্গা লাগানো, তাবিজ-কবজ বিক্রি তাদের প্রধান পেশা। এক সময় নিয়মিত সাপের হাটও বসাতো। কিন্তু সময় বদলেছে তাই মানুষও সচেতন হয়েছে। এসব করে এখন আর মানুষ ভুলানো যায় না। এভাবে তাদের সংসারও ভাল চলছে না।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই সংগ্রামী জীবন বেদেদের। পুরনো পেশায় জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়ায় ‘বিকল্প’ হিসেবে তারা এক পর্যায়ে বেছে নেন মাদক ব্যবসা। টেকনাফ কিংবা উখিয়ায় সাপের খেলা দেখাতে গিয়ে ফেরার পথে সাপের ঝুঁড়িতে করে নিয়ে আসেন ইয়াবা। সেসব বিক্রি করেই চালাতেন সংসার।

সাভারে মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিষয়টি নজরে আসে পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানের। তিনি বুঝলেন বেদেদের নতুন পেশার ব্যবস্থা করতে পারলেই মাদক ব্যবসা থেকে তাদের ফেরানো সম্ভব। সেই লক্ষ্যে ১০৫ জন বেদে নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করান। তাদের সেলাই করা কাপড় কিনতে এগিয়ে আসেন তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানের নাজনীন নামের একজন মালিক। তৈরী পোষাক বিক্রির জন্য আশুলিয়ার জামগড়া ফ্যান্টাসি কিংডম এর সামনে একটি শো-রুম তৈরি করে দেয়া হয়েছে। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘উত্তরন বুটিকস্’।

পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বেদে পল্লীর যুবকদের সাবলম্বী করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। এরমধ্যে ৩৫ জন বেদেকে গাড়ি চালনা প্রশিক্ষণেল ব্যবস্থা করেছেন। যে হাতের মুঠোয় একসময় শোভা পেত বিষধর সাপ সেই হাত তারা ধরছে গাড়ির স্টিয়ারিং। আবার কয়েকজন যুবককে পুলিশ বাহিনীতে চাকরীর সুযোগও তিনি করে দিয়েছেন।

জানা গেছে, ১১ অক্টোবর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টারে বেদেপল্লীর ৩৫ বেকার যুবকের ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। তিন ব্যাচে তারা এই প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। উত্তরার ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলে প্রতিটি ব্যাচকে দুই মাস করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ব্র্যাকের প্রশিক্ষকরা। প্রশিক্ষণ শেষে লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেবে ব্র্যাক। এ বাবদ প্রশিক্ষণার্থীদের কোন খরচ বহন করতে হবে না।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ডা. মুহাম্মাদ মুসার সভাপতিত্বে এইদিন এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. নূরুন নবী তালুকদার এবং ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক এসএম মাহফুজুল হক নূরুজ্জামান, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন, সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক তালুকদার সোহেল, বেদে যুব সংগঠনের নেতা রমজান উপস্থিত ছিলেন।

বেদে সম্প্রদায়ের নেতা রমজান জানান, পুলিশ শুধু অপরাধ ও অপরাধী নিয়েই কাজ করে না। পুলিশ চাইলে বদলে দিতে পারে গোটা সমাজ ব্যবস্থা। হাবিবুর রহমানের বদৌলতে সাভার বেদে পল্লী এর উদাহরণ হয়ে থাকবে। পুলিশ জনগনের বন্ধু এর সার্থকতা মিলে হাবিবুর রহমানের কর্মকান্ডে।

এসপি হাবিবুর রহমান বলেছেন, বেদেপল্লীর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে আইনী পদক্ষেপে এদের সুপথে ফেরানো কঠিন এবং দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এরচেয়ে ভালবাসা দিয়ে তাদের মনজয় করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে কাজ করে সাড়া মিলেছে। ঘুরে দাড়িয়েছে একটি সমাজ। তিনি বলেন, পৈত্রিক পেশাকে ঘৃণা করে নয়, বরং সময়ের প্রয়োজনে সমাজে সম্মানের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহের জন্যই বেদেরা বিকল্প পেশায় যেতে চাইছে। এইকাজে পুরো পুলিশ বাহিনী তাদেরক সহায়তা করছে। হাবিবুর রহমান বলেন, ইচ্ছা আছে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য এলাকার বেদে সমাজের জন্যও এরকম উন্নয়নমূলক কাজ করার।



মন্তব্য চালু নেই