৪ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা অস্ট্রিয়ায়

মাঈনুল ইসলাম নাসিম : “বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৯৭১ সালে অস্ট্রিয়ার রাজনীতিবিদ এবং জনগন সক্রিয় সমর্থন জানায় বাংলাদেশকে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে অস্ট্রিয়াও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্ট্রিয়ানদের সক্রিয় সমর্থনই হচ্ছে বাংলাদেশ-অস্ট্রিয়া দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি”- কথাগুলো বলছিলেন অস্ট্রিয়াতে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত এম আবু জাফর। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের হাল ধরা ছাড়াও ভিয়েনা ভিত্তিক ৪টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত আছেন তিনি স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে। ১৯ মাস আগে অস্ট্রিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ দূতাবাস। সঙ্গত কারণেই এখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস একাধারে একটি স্থায়ী মিশন।

পেশাদার কূটনীতিক এম আবু জাফরের সাথে এই প্রতিবেদকের একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে দূতাবাস ও স্থায়ী মিশনের কার্যক্রমের আদ্যোপান্ত। তিনি জানান, “বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং জাতিসংঘের যে অফিসগুলো ভিয়েনাতে রয়েছে সেগুলো একসময় সুইজার‌্যান্ডের জেনেভাস্থ বাংলাদেশ মিশন থেকে দেখা হতো। দূতাবাস স্থাপনের পর গত এক বছর ধরে ভিয়েনা থেকেই এই কাজগুলো করা হচ্ছে। চারটি সংস্থার সাথে এখানে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আমরা। এগুলো হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ), ইউনাইটেড ন্যাশান্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইউনিডো), ইউনাইটেড নেশান্স অফিস অন ড্রাগস এন্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) এবং কমপ্রিহেনসিভ নিউক্লিয়ার-টেস্ট-ব্যান ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিটিবিটিও)”।

উপরোক্ত সংস্থাগুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থ ব্যাখ্যা করে স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত এম আবু জাফর বলেন, “আপনারা জানেন ইতিমধ্যে বাংলাদেশে রুপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের কাজ অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। যে কোন নতুন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করতে গেলে এটির সেফগার্ড মেকানিজম এবং ভেরিফিকেশন মনিটরিং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কারিগরী দিকগুলোতে সহায়তা করে থাকে ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ)। ভিয়েনাস্থ এই আন্তর্জাতিক সংস্থার ৫টি ডিভিশনের মধ্যে আছে নিউক্লিয়ার সায়েন্স এন্ড এপ্লিকেশন্স ডিভিশন। বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় এবং কৃষিতে ফসলের নতুন জাত বের করার কাজে যে সমস্ত নিউক্লিয়ার আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো এখানকার ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সি’র তত্ত্বাবধানে সংঘটিত হয়। নিউক্লিয়ার সায়েন্স শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেটার ব্যবহার যেমন পানি বিশোধনের নিমিত্তে এবং ভূমির উর্বরতা সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও তাঁরা মূখ্য ভূমিকা রেখে থাকে।”।

রাষ্ট্রদূত আরও জানান, “বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সাভারে আমাদের একটি পরীক্ষামূলক নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর রয়েছে, যেটি নিউক্লিয়ার গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে আনবিক কৃষি, আনবিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা আজ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে সাভারের এই পরীক্ষামূলক নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের মাধ্যমেই। তাছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচারকে সম্পূর্ণ আধুনিকায়নে সাম্প্রতিককালে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সি। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে যেখানে ড্রাইফিশ বা শুটকি তৈরী হয়, সেখানে এক ধরনের মাছির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণেও তাঁরা আমাদেরকে নিউক্লিয়ার টেকনোলজি দিয়ে সাহায্য করেছে“। আইএইএ থেকে বাংলাদেশ সরাসরি লাভবান হচ্ছে এমন আরো অনেক ক্ষেত্র আছে, তালিকাটি অনেক বড় বলে জানান রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, “মূল কথা হলো আনবিক গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিন্তু আঞ্চলিকভাবে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের নিউক্লিয়ার সেক্টরে ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের জন্য তাঁরা আমাদের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের কর্মকর্তা ও গবেষকদের বছরজুড়ে সহায়তা দিয়ে থাকে।

ভিয়েনাতে অবস্থিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অফিস ইউনাইটেড ন্যাশান্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইউনিডো)। বাংলাদেশের শিল্প উন্নয়নে ১৯৮৬ সাল থেকে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে তাঁরা। বাংলাদেশে ইউনিডো’র সহায়তা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, “যেসব ক্ষেত্রে আমাদের অপ্রতুলতা রয়েছে সেগুলো পূরণে সাহায্য করে যাচ্ছে ইউনিডো। সর্বশেষ তাঁরা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) সেটি সম্পূর্ণরুপে আধুনিকায়নে সহায়তা করেছে। বিদেশে রপ্তানী করার ক্ষেত্রে আগে বাংলাদেশী অনেক প্রোডাক্টগুলোর স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষা করিয়ে নিতে হতো যেসব দেশে পাঠানো হবে সেখান থেকে। ইউনিডো’র কল্যানে এখন আর সেটি করতে হবে না। আমাদের বিএসটিআই থেকে পরীক্ষা পরবর্তি যে লেবেলিং করে দেয়া হবে, সেটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো গ্রহন করবে। ইউনিডো’র তরফ থেকে সম্প্রতি তারা বাংলাদেশে একটি ডেইরী হাব এবং ডেইরী একাডেমি প্রতিস্থাপনে ‘প্রাণ’ এবং টেট্রাপ্যাকের সাথে মিলে একটি প্রজেক্ট প্লান করছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ডেইরী প্রোডাক্ট সহজলভ্য হবে এবং এক্ষেত্রে উৎপাদনও বাড়বে”।

ভিয়েনাতেই আছে ইউনাইটেড নেশান্স অফিস অন ড্রাগস এন্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি), যাঁরা বাংলাদেশের বিভিন্ন লিগ্যাল সিস্টেমকে আপডেট করা সহ অন্যান্য দেশের সমপর্যায়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারিগরী সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রদূত এম আবু জাফর জানান, “দুর্নীতি দমন বিষয়ে ইউএনওডিসি’র বিশেষ অভিজ্ঞতা রয়েছে, এ বিষয়েও তাঁরা আমাদেরকে সহায়তা করছে। এমনকি ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম (বন্যপ্রাণী অপরাধ) দমনে তাঁরা আমাদের সাথে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। এইডসের সচেতনতা বৃদ্ধি সহ ট্রান্স-ন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম মোকাবেলায় ইউএনওডিসি বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য সহায়তা দিয়েছে এবং দিচ্ছে“।

রাষ্ট্রদূত বলেন, “ভিয়েনা ভিত্তিক কমপ্রিহেনসিভ নিউক্লিয়ার-টেস্ট-ব্যান ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিটিবিটিও)’র অধীনে সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে যাবতীয় পারমানবিক পরীক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি সংক্রান্ত সিটিবিটি চুক্তি ২০ বছর আগে জাতিসংঘে গৃহীত হলেও তা কার্যকর হয়নি সব দেশ এখনো তাতে স্বাক্ষর না করার কারনে। তবে তাঁদের কাজ থেমে নেই। বিশ্বের কোথাও নিউক্লিয়ার টেস্ট করা হলে সেটি সিটিবিটিও’র যন্ত্রে ধরা পড়ে এবং ভারত ও মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশেও তাদের একটি সাব-স্টেশন রয়েছে চট্টগ্রামে। কোন দেশ সাগরে পানির নিচেও যদি পারমানবিক পরীক্ষা চালায়, সেটি ধরা পড়ে বিশ্বের অন্য প্রান্তে পানির নিচে থাকা তাঁদের বিশেষ স্টেশনে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫ নং আর্টিকেলে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখায় বলা আছে আমরা সম্পূর্ণরুপে নিরস্ত্রীকরণের জন্য কাজ করে যাবো। আমাদের প্রতিবেশী দুই পারমানবিক শক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তান যেহেতু এখনো সিটিবিটিকে সমর্থন করেনি, তাই বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখানটায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে”।

রাষ্ট্রদূত এম আবু জাফর জানান, “অস্ট্রিয়ান কর্তৃপক্ষ ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে ভিয়েনাতে বাংলাদেশের দূতাবাস স্থাপনের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, কিন্তু সেটি তখন সম্ভব হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের আমলে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে অবশেষে এখানে দূতাবাস স্থাপিত হয়। ছোট আকারের অফিস আমাদের, আমার সাথে একজন মাত্র কর্মকর্তা আছেন। দু’দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কে কোন রকম টানাপোড়েন নেই। বানিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত অর্থবছরে দু’দেশের মধ্যকার বানিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫শ’ মিলিয়ন ইউএস ডলারেরও বেশি। উক্ত সময়ে অস্ট্রিয়াতে বাংলাদেশের রপ্তানী প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের পন্য, যার ৯০ শতাংশের বেশি যথারীতি তৈরী পোষাক বা আরএমজি এবং হোম টেক্সটাইল। বাংলাদেশ থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পন্যও আসে অস্ট্রিয়াতে, যার বেশ চাহিদা রয়েছে এখানে। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া থেকে একই সময়ে বাংলাদেশের আমদানী ছিল ছিল ৫৮ মিলিয়ন ডলারের পন্য। এখান থেকে বাংলাদেশে যায় টেক্সটাইল মেশিনারিজ, বিশেষ করে টেক্সটাইল প্রিন্টিং মেশিন”।

অস্ট্রিয়া একটি ‘ল্যান্ডলক কান্ট্রি’ অর্থাৎ সীমান্তবর্তী এলাকায় কোন সাগর নেই। চারিদিকে স্থলভূমিই দেশটির সীমানা প্রাচীর। লোকসংখ্যা মাত্র ৮৫ লক্ষ। রাষ্ট্রদূত জানালেন. “বাইরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁদের পুরনো অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য তথা যে দেশগুলো পরবর্তিতে স্বাধীন হয়েছে অর্থাৎ বলকান অঞ্চলের দেশগুলোই সবসময় তাঁদের ফোকাস। স্বল্প জনসংখ্যার একটি দেশ হিসেবে খুব দূরে গিয়ে বিনিয়োগে তাঁরা এখনো ততোটা আগ্রহী নয়। ভিয়েনাতে আমাদের দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর এখানকার বিজনেস চেম্বার ও ব্যবসায়ীদেরকে আমরা বোঝাবার চেষ্টা করছি বাংলাদেশ তাঁদের জন্য একটি সম্ভাবনাময় দেশ। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশ সরকার যেসব ইনসেন্টিভ দিচ্ছে সেগুলো আমরা তুলে ধরছি। আসছে সেপ্টেম্বরে এখান থেকে একটি ট্রেড ডেলিগেশন বাংলাদেশে যাবে, নেতৃত্ব দেবেন অস্ট্রিয়ান চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশে বিনিয়োগের যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে, আশা করছি এই ডেলিগেশন বাংলাদেশে যাবার পর সেই ধারনা তাঁরা লাভ করবেন এবং বাংলাদেশে অস্ট্রিয়ান বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত হবে”।

লেখক : ইতালি প্রবাসী, সাংবাদিক



মন্তব্য চালু নেই