৫ মে হেফাজতের কোনো কর্মসূচি নেই

আগামীকাল ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরের ঘটনার তৃতীয় বার্ষিকীতে কোনো কর্মসূচি নেই কওমি মাদরাসা ভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের। এ উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি না থাকলেও ঢাকা মহানগরীতে লালবাগ এবং বারিধারায় পৃথক আলোচনা ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে।

এব্যাপারে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘৫ মে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি নেই। তবে বিভিন্ন জায়গায় দোয়া অনুষ্ঠিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘ইসলামের শরিয়ত অনুযায়ী দিবস পালনের কোনো নিয়ম নেই। ৫ মে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের মাগফেরাত কামনায় আমরা সব সময় দোয়া করি। শুধু ওইদিনই নয়, যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রুহের মাগফেরাত মাগফেরাত কামনায় আমরা সব সময় দোয়া করি।’

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’র কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য মাওলানা আলতাফ হোসাইন বলেন, ৫ মে বাদ যোহর লালবাগস্থ কেন্দ্রিয় সমন্বয় কার‌্যালয়ে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে।

তিনি বলেন, এই দোয়া অনুষ্ঠানে হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ এবং মহানগরের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।

৫ মে কর্মসূচি প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ফজলুল করিম কাসেমী বলেন, হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগীর উদ্যোগে আগামী ৫ মে দুপুরে বারিধারা জামিয়া মাদানিয়া মাদরাসা আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় আশা করি হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী উপস্থিত থাকবেন আশা করছি।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের উৎপত্তি
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের পর ‘কথিত নাস্তিক’ ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ করে আলোচনায় আসে কওমি মাদরাসাভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সংগঠনটি এক মাসের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় দুটি লংমার্চ’ ও ‘অবরোধ’ কর্মসূচি পালন করে। এরপরই দেশ-বিদেশে আলোচনাচিত হয় সংগঠিনটি।

৫ মে শাপলা চত্ত্বর
ওই বছরের ৫ মে ফজরের নামাযের পর থেকে রাজধানীর ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে অবস্থান নিয়ে সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় হাজার হাজার হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা। এরপর ওইদিন তারা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার অনুমতি চাইলে পুলিশ দুপুর ৩টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত সেখানে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়।

কিন্তু এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সহিংসতার দিকে মোড় নেয় এবং শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন হেফাজতের লাখ লাখকর্মী-সমর্থক। ওই দিন মধ্যরাতে পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবির অভিযানের মুখে হেফাজতের কর্মীরা শাপলা চত্বর এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন ।

ভোর ৫টা- পুরো মতিঝিল এলাকার পরিবেশটা একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকার মতো মনে হয়েছিল। আগের দিনের সহিংস বিক্ষোভের অনেক চিহ্ন আশেপাশে ছড়িয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৫ এবং ৬ মে দুইদিনের সারাদেশে ২৮ জনের নিহত হওয়ার কথা বলেছিল।

এই ঘটনার দুইদিন পর হেফাজতের আমির আল্লামা আহমদ শফী এক বিবৃতিতে দাবি করেন, অভিযানের সময় আড়াই থেকে তিন হাজার লোক মারা গেছেন। রাতের অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক দেখ দিয়েছিল। কিন্তু গত তিন বছরে এই দাবির পক্ষে তারা কোনো তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেনি।

হেফাজতের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, ঢাকায় সহিংসতার ঘটনায় বহু মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। অনেকে গ্রেফতারও হলেও তাদের বিষয়ে কোনো খবর রাখেনি সংগঠনটি।

হেফাজতে পরস্পর অবিশ্বাস আর দ্বন্দ্ব
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, মূলত হেফাজতের কেন্দ্রীয় দপ্তর রাজধানী ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে অবস্থতি।এ কারণে কেন্দ্রের কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিত থাকে তুলনামূলক অনেক কম। নিজেদের মধ্যে হাতাশা, অবিশ্বাস এবং অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্যে ধারণ করেছে। এছাড়াও দ্বন্দ্বের কারণে ঢাকা মহানগরী কমিটি প্রকাশ্যে দুইটি ভাগে বিভক্ত। তারা আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালন করে।

শুধু তাই নয়, এই বিভক্ত এমন পর্যায়ে চলে গেছে, ঢাকা মহানগরীকে নিজেরা দুইভাগে বিভক্ত করে কমিটি পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় দফতরে। যদিও এখন পর্যন্ত ওই কমিটির বিষয়ে কোনো দিক নির্দেশনা দেয়নি কেন্দ্র। এ অবস্থায় সংগঠনটি নিজেদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে সরব অবস্থান থেকে সরে দাঁড়িয়েছে।

তাছাড়া এখন হেফাজতের কেন্দ্রীয় এবং ঢাকা মহানগরী এবং জেলা পর্যায়ের নেতারা একজন আরেকজনকে বিশ্বাসও করতে পারছে না। নিজেরা হতাশে ভোগে ওই কর্মসূচি সঠিক ছিল কি না। এই আন্দোলনকে পুজি করে অনেকে বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। হেফাজতের আমির আহমদ শফীর ছেলে আনাছ মাদানি এবং কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা হেফাজতের নামে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন শোনা যাচ্ছে।এছাড়া হাটহাজারী মাদরাসার নামে রেলের অর্ধশত কোটি টাকার জমি বরাদ্দ নেওয়াসহ নানা সুবিধার নেওয়ার অভিযোগ আছে।

এছাড়াও মামলা মোকদ্দমা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। ফলে হেফাজতের পক্ষ থেকে এমন কোনও কর্মসূচি নেই যা সরকারের বিপক্ষে যায়।
এক হেফাজত নেতা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, আল্লামা শফীর ডাকে সাড়া দিয়ে ৫ মে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু তারা তাদের স্বার্থে সেদিন অবস্থান নিয়ে এতো মানুষকে বিপদে ফেলেছে। এমনকি হেফাজতের শীর্ষ নেতারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলছেন।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে বিভক্তি হেফাজতের আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল ঢাকায়।কিন্ত এখন ঢাকাই হেফাজতে দুইভাগে ভাগে হয়ে গেছে। এই দুইগ্রুপের এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে লালবাগ জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া মাদরাসা এবং অপর গ্রুপের নেতৃত্ব বারিধারা জামিয়া মাদানিয়া মাদ্রাসা। এরমধ্যে লালবাগের মাদরাসায় সংশ্লিষ্ট ইসলামী ঐক্যজোট এবং বারিধারার মাদরাসায় সংশ্লিষ্ট হেফাজত নেতারা জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

হেফাজতের কর্মসূচি শুরুতে লালবাগ জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে পরিচালতি হয়। ৫ মের দিন হেফাজতের আমির এখনই অবস্থান করেছিলেন। এরপর বারিধারায় হেফাজতের কর্মকান্ড চলছে।এ থেকেই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। জমিয়তের কার্যক্রম পরিচালিত হয় রাজধানীর জামি’আ মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসা থেকে। লালবাগ থেকে হেফাজতের কার্যালয় স্থানান্তর করা হয় বারিধারার ওই মাদরাসায়। বারিধারায় হেফাজতের কার্যালয় স্থানান্তরের আগ পর্যন্ত রাজধানীতে হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণে রাখে লালবাগপন্থীরা। এরা চান হেফাজতকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। বিগত তিন বছর ধরেই লালবাগ ও বারিধারা মাদ্রাসার নেতারা পৃথক পৃথকভাবে আলেঅচনা সভা এবং বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।

জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা মহানগর হেফাজতের আহ্বায়ক হচ্ছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী ও সদস্য সচিব জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহ-সভাপতি জুনায়েদ আল হাবীব। প্রস্তাবিত কমিটিতে এদেরকে ঢাকা মহানগর উত্তরের রাখা হয়েছে। আর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক হচ্ছেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির হাফেজ মাওলানা আতাউল্লাহ এবং সদস্য সচিব হচ্ছেন ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ। মুফতি ফয়জুল্লাহ হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব পদে রয়েছেন।

ঢকা মহানগরী কমিটিকে দুইভাগে বিভক্তি করার প্রসঙ্গে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘হেফাজতের কর্ম পরিধি বাড়াতেই ঢাকা মহানগর কমিটিকে উত্তর ও দক্ষিণে দুই ভাগ করা হচ্ছে। এ কমিটি গঠনের প্রস্তাবও ইতিমধ্যে কেন্দ্রে এসেছে। তবে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।’

হেফাজতে ইসলামে দ্বন্দ্ব এবং বিভক্তির প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, আমি মনে করি, এখানেও দ্বন্দ্বের কোন অবকাশ নেই। হেফাজতে ইসলাম একটি বিশাল অরাজনৈতিক, ইসলাহী সংগঠন। এই সংগঠনের আশ্রয় নিয়েছে অসংখ্য মানুষ। হেফাজতে ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা হচ্ছেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। তার নেতৃত্বের ব্যপারে কারো দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকার প্রশ্নই উঠে না। তিনি যখন যে নির্দেশ প্রদান করেন, আমরা তা পালনের সাধ্যমত চেষ্টা করি। তিনি যখন যেভাবে কর্মসূচী পালন করতে বলেছেন আমরা তখন সেভাবে কর্মসূচী পালন করেছি।

ঢাকা মহানগরীকে দুইভাগে বিভক্ত করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আল্লামা শাহ আহমদ শফী। এই সংগঠনকে গতিশীল করার জন্য তিনি যে কোন সময়, যে কোন ধরণের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন। তিনি যদি হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগরকে দুই ভাগে ভাগ করে সাংগঠনিক কার্যক্রমকে আরো বেগবান ও গতিশীল করা প্রয়োজন মনে করেন তবে করে দেবেন এতে আপত্তির কিছুই নেই।’ বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই